পাকিস্তান সৃষ্টির পর, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলার মানুষের ওপর জাতিগত ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন শুরু হয়। এর প্রতিবাদে নতুন এক বোধ জাগরিত হতে শুরু তরুণপ্রজন্মের মনে। পরবর্তীতে, জান্তাদের সীমাহীন অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের দাবিতে একাট্টা হয়ে ওঠে পুরো বাঙালি জাতি। ছাত্রদের নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে, সত্তরের দশকে তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয় কৃষক-শ্রমিকসহ আপামর জনতা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাত কোটি মানুষ এককণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে, আর সেই কন্ঠস্বরটি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্ত ভূখণ্ডে, স্বাধীনভাবে, শোষণমুক্ত হয়ে বাঁচার জন্য, বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির মধ্যে নতুন চেতনার যে অদম্য বহির্প্রকাশ ঘটে- সেটাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার শুরু ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়ে এবং চূড়ান্ত গন্তব্য অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে।
মূলত, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে, পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এসময় থেকেই পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কথা ভাবতে থাকেন তিনি। ওই বছরের ডিসেম্বরেই, করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ ভাগ বাঙালির হাজার বছরের চেতনা, সংস্কৃতি, জীবনাচারকে বলপ্রয়োগ করে দমনের অপচেষ্টা শুরু করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে, কয়েকদিনের মধ্যেই, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। এ ব্যাপারে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী বাংলাভাষার ওপর আঘাত হানলো…। আমরা ভাষার ওপর এ আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১১ মার্চ তারিখে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন শুরু করি। অন্যান্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে আমরা শোষকগোষ্ঠীর আঘাতের মোকাবিলা করি।’ মূলত, সেসময় প্রথমত ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার জন্য তরুণপ্রজন্মের মধ্যে স্বজাত্যবোধ জাগিয়ে তুলতে এই উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যখন আবারো উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন, তখন ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে এর প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে তরুণ নেতা শেখ মুজিব। ভাষা আন্দোলনের জন্য তাকে পরে জেলেও যেতে হয়। তবে এই আন্দোলনের সূচনা করার মাধ্যমে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অভিন্ন জাতিসত্তার যে বুনিয়াদ রচনা করেন, তা একটি অখণ্ড জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেয়। স্বাধীনতা অর্জনের বিভিন্ন ধাপে, বাংলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মনে পর্যন্ত স্বজাত্যবোধ জাগ্রত হয় এবং তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
বঙ্গবন্ধু: বাঙালির স্বপ্নের ফেরিঅলা
একদিকে পর্বতশৃঙ্গ, দুই দিকে শিলা ভূমি এবং অন্যদিকে বিশাল জলরাশি; এই হলো বাঙালি জাতির বৃহত্তর ভৌগলিক অবস্থান। হাজার হাজার বছর আগে থেকে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনাচার গড়ে উঠেছে লোকায়ত সম্প্রীতি, সহনশীল মিশ্র সংস্কৃতি, স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলিত আবাসভূমি হিসেবেই ইতিহাসে বাংলার পরিচয়। এমনকি আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে মুঘল আমলেও বারবার বিদ্রোহ হয়েছে এই ভূখণ্ডে। বঙ্গভূমিকে তাই ‘বুলগাকপুর’ বা বিদ্রোহের নগরী বলে ডাকা হতো সেসময়। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলেও বঙ্গভূমির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে একবার বঙ্গভঙ্গ ও পরে আবার তা রদ করতে হয়েছে। ইংরেজরা এই ভেদনীতির মাধ্যমে কৌশলে বাংলার মানুষের মধ্যে মুসলিম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে এবং তাদের শাসন অব্যাহত রাখে।
১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফেরানোর চেষ্টা করা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট করে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ চন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হকের মতো বাঘা বাঘা নেতারা। তবে ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আবারো অসাম্প্রদায়িক বৃহত্তর বাংলা গঠনের চেষ্টা শেষ হয়ে যায়। বৃহত্তর বঙ্গ বা বাঙালিদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা এই সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষের অনেক নেতার মনে এলেও, তা বাস্তবায়ন করার মতো সাহস কারো হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু হাজার বছর ধরে বাংলার মানুষের মনের মধ্যে যে সুপ্ত বাসনা বহমান ছিল, তাকে সফলভাবে রূপদান করতে সামর্থ্য হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই দুই হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র নেতা, যিনি বাঙালির স্বজাত্যবোধকে পরিপূর্ণভাবে তীব্র জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। একারণেই তার ওপরে আস্থা রেখেই সাত কোটি মানুষ একটি স্বাধীন আবাসভূমির জন্য নিজেদের জীবনকে বাজি রাখার দুঃসাহস পায় এবং দীর্ঘ সংগ্রাম এবং রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ
বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বিশেষ করে মাতৃভাষায় অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং উপনিবেশিক আচরণের প্রতিবাদেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের সূত্রপাত। দেশভাগের অল্প কিছুদিন পর থেকেই বাঙালির মানসপটে এই চেতনা গুঞ্জরিত হতে শুরু করে। পরবর্তীতে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণমানুষের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবধারা জেগে ওঠে। এই আন্দোলন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়। কথা হয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন-ধর্মঘট শুরু করবো, আর ২১ তারিখ আন্দোলন শুরু হবে।’ এসময় ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। যার পরিপ্রক্ষিতে, ১৯৫২ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়ে ছাত্র-জনতা। কিন্তু গুলি চালিয়ে বাঙালির বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে পাকিস্তানি হানাদাররা। মায়ের ভাষার কথা বলার অধিকারের জন্য সূর্যসন্তানদের রক্তদান পুরো জাতিকে একতাবদ্ধ করে তোলে। এই ভাষাভিত্তিক আন্দোলনই পরবর্তীতে ,ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপ নেয়। যার প্রভাব পড়ে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে।
ইতোমধ্যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় গঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। এবং বাংলাদেশ অংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী। এর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার কারণে জেলে রাখা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তবে প্রভাবশালী তরুণ নেতা হিসেবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগ গঠনের ব্যাপারে মত নেওয়া হয়। এপ্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, নাকি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম- ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।’ এরপর জেলে থাকা অবস্থাতেই তাকে দলের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ১৯৫৩ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
বিকাশ পর্ব
১৯৫৪ সালের প্রদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। মুসলিম লীগের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় এই নির্বাচন। পূর্ববঙ্গের ২৩৭টি আসনের মধ্যে মাত্র ৯টি আসনে জিততে সমর্থ্য হয় মুসলিম লীগ। ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে এবারো মানুষের কাছে ভোট চেয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টিকারী একচ্ছত্র এই দলটি। কিন্তু এর বিপরীতে ভাষা-সংস্কৃতির অধিকার রক্ষা, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন মানবিক জীবন, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে একচেটিয়াভাবে বাকি সব আসনে জিতে যায় সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ। নৌকা মার্কা পরিণত হয় বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রের কারণে এই মন্ত্রিসভা গঠনের মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় বাতিল হয়ে যায়। তবে মানুষের মধ্যে যে জাগরণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি উপনিবেশিকতা এবং ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবোধের বহির্প্রকাশ ঘটে এই নির্বাচনে। একারণে মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতি সমর্থন জানিয়ে, ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে, সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী মুসলিম লীগ সরাসরি আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়।
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু দেশজুড়ে দলকে আরো সংগঠিক করে, পুরো জাতিকে নিয়ে অধিকার আন্দোলনের লড়াই জোরদার করার জন্য, ১৯৫৭ সালেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। চষে বেড়াতে থাকেন বিভিন্ন জেলা। শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও শোষণমুক্তির স্বপ্ন ছড়িয়ে তীব্র জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে তোলেন প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মনেও। যার ফলে, ১৯৬২-৬৩ সালে সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ছাত্র-জনতা। এসময়, সোহরাওয়ার্দীরে মৃত্যুর পর, আওয়ামী লীগের তথা পুরো জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু। জাতীয় চেতনার উন্মেষের ফলে বাঙালির সুপ্ত জাতিসত্তার প্রকাশ ঘটে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’ স্লােগানটি। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের স্লোগান খেয়াল করলে এর ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৩-এর পর বাঙালিকে জাগানোর জন্য যে স্লোগান শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত শ্রম ও অসামান্য তৎপরতায় তা সফল হয়। ১৯৬৯ সালে তাই জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়: ‘জেগেছে জেগেছে, বাঙালি জেগেছে’, ‘বীর বাঙালি জেগেছে, রক্তসূর্য উঠেছে’।
জাতীয় চেতনার বিস্ফোরণ
জনগণকে প্রস্তুত করার একটা পর্যায়ে এসে, ১৯৬৬ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির সনদ বলে খ্যাত ‘ছয় দফা’। স্বায়ত্তশাসন, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে একে ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ বলে অভিহিত করেন বঙ্গবন্ধু। এসময়েই তিনি হন আওয়ামী লীগের সভাপতি। ছয় দফার সমর্থনে দেশজুড়ে সভা-সমাবেশ করেন। লিফলেট-বুকলেট প্রচার করতে থাকেন। ফলে গ্রাম-গ্রামান্তর পর্যন্ত সোচ্চার হয়ে ওঠে ছয় দফার পক্ষে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে পাকিস্তানিরা। তাই বঙ্গবন্ধু যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও তাকে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘমেয়াদে জেলে রাখা হয়। মূলত বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসী নেতৃত্ব ও গগনচুম্বি জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে, তাকে জেলে ঢোকায় পাকিস্তানের সামরিক সরকার। কিন্তু জাতীয় মুক্তির যে বীজমন্ত্র তিনি রোপণ করেছিলেন, তা ততদিনে শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে গেছে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। তাই বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুপুস্থিতি কখনোই তার আদর্শিক মতাদর্শ বিনির্মাণে বাধা হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু জেলে যাওয়ার পরও আন্দোলন চলতে থাকে। ছয় দফাকে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে পুরো জাতি।
এরকম এক পরিস্থিতিতে, ১৯৬৮ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর নামে দায়ের করা হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ নামের একটি মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)। জেলে থাকা অবস্থাতেই নতুন করে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। অভিযোগে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যরা পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন’। সোজা কথায় বলতে গেলে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন এবং পরিচালনার জন্য বাঙালি সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে ধারাবাহিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন, সেটাকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন ব্যক্তির নামে এই মামলা দায়ের করে সামরিক সরকার। এসময় দেশজুড়ে মানুষ স্লোগান দিতে থাকে ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে একাকার হয়ে যেতে থাকে বাঙালির মানসপটে।
পরবর্তীতে প্রবল জনরোষের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের জান্তারা এবং সেদিনই কারাগার থেকে মুক্তি পান বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিমূর্ত প্রতীকে পরিণত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাকে। একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র বঙ্গভূমি তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের জন্য সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ নেতা মেনে গণরায় দেন সাত কোটি বাঙালি। পুরো জাতিকে জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রায় দুই যুগ ধরে যে শ্রম দিয়েছেন, এই পর্যায়ে এসে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত সেই জাতিকে দেখে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিলেন তিনি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পদত্যাগ ও সাধারণ নির্বাচনের জন্য কঠোর অবস্থান নিলেন বঙ্গবন্ধু। তীব্র জাতীয়তাবোধে জাগ্রত বাঙালি জাতির তুমুল গণআন্দোলনের মুখে, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন হয়। ইয়াহিয়া ক্ষমতা নেন এবং নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। দেশজুড়ে শুরু হয় নির্বাচনি প্রচারণা। এর আগে এভাবে কখনো কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা সবার মিলিত স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে বের করে আনতে এবং সামরিক জান্তার পতনের জন্য আপামর জনতার এই অংশগ্রহণ ইতিহাসের এক অভুতপূর্ব অধ্যায়। সমাজের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিক্ত-নিম্নবিত্ত, বৃদ্ধ-শিশু থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি মানুষ তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় জেগে ওঠে এসময়।
১৯৭০-এর নির্বাচন: তীব্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ
সাত কোটি বাঙালির তীব্র দাবির মুখে, দেশভাগের পর পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসের প্রথম জাতীয় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। এসময় ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেনো?’ স্লোগান-পোস্টারে দেশবাসীর কাছে পাকিস্তানিদের শোষণ-বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এই শ্মশানকে সোনার বাংলায় পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন, ছয় দফার বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখান। জনতাও লুফে নেয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের এই সুযোগকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একচেটিয়াভাবে ভোট দেয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে। যার ফলে, জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জিতে পুরো পাকিস্তানের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। এছাড়াও প্রাদেশিক পরিষদেও ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হওয়া এই দলটি।
কিন্তু পাকিস্তানি জান্তারা বাঙালির হাতে দেশ শাসনের অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ষড়যন্ত্র করে কালক্ষেপণ করতে থাকে। যার ফলে, ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসেই উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। মুখে মুখে ঘুরতে থাকে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্লোগানে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সাত কোটি বাঙালি। ঐতিহাসিক এই নির্বাচনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি পুরো জাতিকে একসূত্রে বাঁধতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জয় বাংলা বলতে আসলে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির জয়কে বোঝানো হয়, যা সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, এটি চূড়ান্ত জাতীয়তাবাদী স্লোগানে পরিণত হয় আপামর জনতার কাছে।
নির্বাচনের পর, ক্ষণিকের হঠকারিতায় পাকিস্তানিদের ফাঁদে পা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন বঙ্গবন্ধু। দুই যুগের দীর্ঘ সংগ্রাম যাতে কোনো ভুলের কারণে বিনষ্ট না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকলেন তিনি। জাতির সঙ্গে বেঈমানি না করতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রকাশ্যে শপথ করালেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকাশ্য জনসভায়। এদিকে দেশের স্বাধীনতার পটভূমি তৈরির কাজ সম্পন্ন করে, নির্বাচনের আগে থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজর রাখছিলেন বাঙালি জাতির এই একক নেতা। নির্বাচনে জেতার পর, প্রতিটি ধাপ বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন তিনি। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এই অসহযোগ আন্দোলন ছিল সক্রিয় অসহযোগ। ৩ মার্চ হরতাল ঘোষণা করেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ও সার্বিক নির্দেশনা দিন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিটি বাঙালি পরিণত হয়ে ওঠে একেকটি আদম-বোমায়। তার নির্দেশে ব্যাংক-বীমা-সরকারি অফিস সব বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নিজের বাসভবনসহ বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উড়তে থাকে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানিরা ঢাকার ঘুমন্ত মানুষদের ওপর গণহত্যা চালানো শুরু করলে, স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নামে আপামর জনতা। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর চূড়ান্তভাবে মুক্তির স্বাদ পায় বাঙালি জাতি।
জয় বাংলা, বাংলার জয়
মূলত, ভারতীয় উপমহাদেশে জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক এক নতুন ধরনের দেশ প্রতিষ্ঠা হলো ভূমিপুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে; ধর্ম নয়-বর্ণ নয়, বরং হাজার বছরের লোকায়ত জীবনাচারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে জন্ম নিলো বাংলাদেশ।
এরপর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্ধারিত করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির প্রথম দশ চরণ। ১৯৬৬ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও এই গানটি বাজানো হয়, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এটি হবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।’ পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের ৩ মার্চ ছাত্রলীগের গণসমাবেশ ও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সমাবেশেও দশ লাখ মানুষ দাঁড়িয়ে এই গানটি গায়। গানে-কবিতায়-স্লোগানে এভাবেই সাংস্কৃতিক আবহের মধ্য দিয়ে পুরো জাতিকে এক পাটাতনে নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
এমনকি এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চিন্তাও নতুন নয়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই বাংলাদেশ গঠনের ভাবনা আসে বঙ্গবন্ধুর মনে, বিভিন্ন সময় তিনি এটি প্রকাশও করেছেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় নিজেদের ভূখণ্ডের নাম হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ নামটি চূড়ান্ত করেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। এরপর থেকে মৌখিকভাবে বাঙালিরা এই অঞ্চলকে বাংলাদেশ হিসেবেই অভিহিত করতে শুরু করে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু একজন তরুণ নেতা থেকে ক্রমেই বাংলার মানুষের আস্থার সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছে যান। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও অগাধ দেশপ্রেমের কারণেই তিনি পুরো জাতিকে একসূত্রে আনতে পেরেছিলেন। যে কারণে, দুই হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই পেরেছেন সফলভাবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন বাংলাদেশকে।