কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়াতে হবে : বঙ্গবন্ধু

।। জগেশ রায় ।।
শুক্রবার, ২৭ মে, ২০২২

বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান জাতির জনক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ

 

আমার প্রিয় দেশবাসী

সংগ্রামীঅভিনন্দনও সালাম গ্রহণ করুন। কাল ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। শহিদের রক্তে রঞ্জিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আত্মত্যাগ ও পরম আকাঙ্ক্ষায় মূর্ত এই দিনটি। আজ আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি সেইসব অকুতোভয় বীর শহিদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যাদের জন্য সোনার বাংলা আজ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের শুরু। এই যুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম আমরা শুরু করেছি। এই সংগ্রাম অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে কঠোর পরিশ্রম করি এবং সৎপথে থাকি তবে ইনশাল্লাহ জয় আমাদের অনিবার্য।

সংগ্রামী বন্ধুরা আমার

স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কী নিয়ে কোন অবস্থায় আমাদের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল, তা আপনারা ভালোভাবে জানেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে শূন্য হাতে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হয়। আমাদের শুরু করতে হয়েছিল পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সময়ের দিক থেকে মাত্র তিন বছর। একথা সত্য যে, তিন বৎসর আপনাদের কিছু দিতে পারবো না— এ কথা আমি আপনাদের বলেছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেয়ার খাতা একেবারে শূন্য পড়ে থাকেনি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য কোটি কোটি মণ খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করা ছাড়াও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিক ভাইদের নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি, বেতন কমিশনের সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন, পাটের নিম্নতম মূল্য বৃদ্ধি এবং প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীদের মর্যাদা দিয়ে বর্ধিত হারে বেতন প্রদান— এই জাতীয় কয়েকটি ব্যবস্থা, যা সরকার কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও কার্যকর করেছে। একই সাথে আমাদের দেশের বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করা হয়নি, মীরপুর, নয়ারহাট, তরাঘাট প্রভৃতি স্থানে নতুন নতুন সেতু নির্মাণ করে দেশে উন্নততর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। আপনারা নিশ্চয়ই এটাও জানেন, যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের জরিপ কাজের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছিল, খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছিল। দেশবাসীও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির কিছুটা ফল লাভ করতে শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপযোগী প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেনা, বিমান ও নৌ-বাহিনী, বিডিআর, রক্ষী বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে গঠন করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশ পুনর্বাসন পর্যায় শেষ করে প্রবেশ করেছিল পুনর্গঠনের নতুন দিগন্তে। ‘৭২-এর দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি, ‘৭৩ এর আঞ্চলিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও দেশ যখন পুনর্গঠন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে উপর্যুপরি দু’টি বিপর্যয় নেমে এল। প্রথমত মুদ্রাস্ফীতি। তার ফলশ্রুতি আমাদের অত্যাবশ্যক আমদানি পণ্যের অবিশ্বাস্য হারে মূল্য বৃদ্ধি। অন্যদিকে আমাদের রফতানি পণ্যের মূল্য বিশ্ব বাজারে এই সময়ে বৃদ্ধি তো পায়ইনি, বরং অনেকাংশে কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যা। যার ফলে ১৭টি জেলার ৪ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো মারাত্মকভাবে। ১০ লক্ষ টনের বেশি খাদ্যশস্য হলো নষ্ট। এই দুই বিপর্যয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের জাতীয় পুনর্গঠন প্রচেষ্টা হয়েছে বিঘ্নিত। এই সাথে একদল নরপশু চোরাকারবারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোর, মজুতদার ও ঘুষখোরের হীন কার্যকলাপ অবস্থার আরো অবনতি ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ আজ তিনটি মহাবিপদ তথা তিন শত্রুর মোকাবেলা করছে।

(১) মুদ্রাস্ফীতি— যা আজ সারা বিশ্বে ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে, (২) প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যা এবং (৩) চোরাকারবারী, মুনাফাবাজ, মজুতদার ও ঘুষখোর এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামে। সেপ্টেম্বরে বন্যার তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর থেকে ৫,৭০০ লঙ্গরখানা খুলে প্রতিদিন ৪৪ লক্ষাধিক লোককে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে এবং কোনো কোনো অঞ্চলে এখনও তা অব্যাহত আছে। হেলিকপ্টার থেকে নৌকা পর্যন্ত যখন যেটা পাওয়া গেছে, তাতে করেই এই তৈরি খাদ্য পৌছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বন্যাকবলিত মানুষের কাছে। বন্যার অব্যবহিত পরেই নতুন করে আবাদ শুরু করার জন্য সরবরাহ করা হয়েছে বীজ ও চারা। দেয়া হয়েছে কৃষি ঋণ, টেস্ট রিলিফ, ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা, পরনের কাপড় ও ঔষধপত্র । আমাদের সাধ্যের কিছুই আমরা অবশিষ্ট রাখিনি। বাংলার মানুষের এই মহাবিপদের দিনে বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্যও আমরা পেয়েছি। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই সাহায্য নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। আজ এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, মানবতার ডাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার পরিবর্তে বিশ্বের, কোনো কোনো সংবাদপত্র যখন লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে মারা যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছিল ও দুঃখী মানুষের জন্য উপদেশ খয়রাত করছিল, তখন বাংলাদেশ সরকার তথা এ দেশের মানুষ বিশ্বের বৃহত্তম ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে অবস্থা আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছে। সম্পদ নিতান্ত সীমিত হওয়া সত্ত্বেও সুষ্ঠু ও সুচারু বিলি-বণ্টনের মাধ্যমে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি।

প্রিয় বন্ধুরা

আমি আগেই বলেছি, তিন শত্রুর বিরুদ্ধে নতুন এক প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরানিয়োজিত।

আজ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ভীতির দরুন তেল, খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্য আমদানির জন্য আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি তথা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের চক্রে অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের ন্যায় বাংলাদেশের রফতানি পণ্য উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। তাই দেশ-বিদেশের মুদ্রাস্ফীতির মোকাবেলায় উৎপাদন বৃদ্ধি, মিতব্যয়িতা ও মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনা, ওয়েজ আর্নার স্কিমে পণ্য আমদানি তথা পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু বিলি বণ্টনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা আমরা করছি। বাজারে ইতোমধ্যেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর শুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ৷

খাদ্য আমদানি ব্যয় হ্রাসের জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ঘাটতি পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহের নীতি আমরা গ্রহণ করেছি- এ কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। দেশের খাদ্য দেশে মজুত করে দুঃসময়ে ন্যায্য মূল্যে সরবরাহই এর প্রধান উদ্দেশ্য। কৃষক ভায়েরা এ ব্যাপারে যাতে সরকার নির্ধারিত মূল্য পান এবং কোনো প্রকার হয়রানির সম্মুখীন তাদের না হতে হয় তার প্রতি নজর রাখা হচ্ছে। তাই খাদ্য সংগ্রহ অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য। বাংলাদেশের অফুরন্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন। এই পথে আমরা বেশ কিছুটা অগ্রসরও হতে পেরেছি। প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে একাধিক ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। এই কারখানাসমূহে যে সার উৎপাদন হবে, তা দিয়ে শুধু দেশেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না, আমরা তা বিদেশেও রফতানি করতে পারবো। আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় তেলের সন্ধান লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তেল অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য আমরা ইতোমধ্যেই কয়েকটি বিদেশি তেল কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।

মুদ্রাস্ফীতির পরেই আসে প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যার কথা। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দু’টি জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন – সময় ও অর্থ পাকিস্তানি শোষকরা ২৫ বৎসরের শাসন ও শোষণে এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। বরং বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বাংলাদেশের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে গেছে। বিরাট ঋণের বোঝা। বাংলাদেশ সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে চেষ্টা করছেন। আমাদের নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামে সর্বশেষ ও সর্বপ্রধান শত্রু

চোরাকারবারী (স্মাগলার), কালোবাজারী, মুনাফাবাজ ও ঘুষখোরের দল। মানুষ যখন অনাহারে মারা যায়, তখনও এইসব নরপশুর দল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখের গ্রাস অন্যত্র পাচার করে দিয়ে থাকে। বিদেশ থেকে ধার কর্জ, এমনকি ভিক্ষা করে আনা পণ্য ও বাংলার সম্পদ মজুদের মাধ্যমে এরা মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। এদের কোনো জাত নেই, নেই কোনো দেশ। এইসব নরপশুদের উৎখাতে আমি আপনাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চাই। সরকার ইতোমধ্যেই সামরিক বাহিনীসমূহ নিয়োগের মাধ্যমে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিছুসংখ্যক চোরাচালানীকে গুলি করে হত্যাও করা হয়েছে। চোরাচালান অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। সীমান্ত প্রহরায় নিযুক্ত বাহিনীসমূহ ও সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে এই উদ্দেশ্যে গঠন করা হচ্ছে গণকমিটি। চোরাচালান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হলে চাই জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা। আমি আশা করি, জনগণ এ কাজে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন। এ ব্যাপারে একটা সুখের বিষয় এই যে, ভারত সরকারও চোরাচালান বন্ধের জন্য তাদের এলাকায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

এখানে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারীর কথা উল্লেখ না করে আমি পারছি না। রাতের অন্ধকারে সন্ত্রাস সৃষ্টিই তাদের প্রধান উপজীব্য। ৪ জন সংসদ সদস্যসহ তিন হাজার আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে এদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। তারা জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করে জনগণের দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধি করতেও দ্বিধা করছে না। সরকার তো দূরের কথা, কোনো শান্তিপ্রিয় নাগরিকই এটা বরদাস্ত করতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে জনগণের কোনো কল্যাণ বা কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। এ পন্থা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহু আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এছাড়াও ক্ষমাপ্রাপ্ত কিছু কিছু লোক দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেয়া হবে না। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান— বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন, তারা সকলেই এ দেশের নাগরিক । প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা সম-অধিকার ভোগ করবেন।

প্রিয় দেশবাসী

বিগত একটি বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনন্য সাফল্য সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু বলতে চাই না। আপনারাই তার বিচার করবেন। শুধু এইটুকু বলব, জাতিসংঘে আজ বাংলাদেশ স্বীয় ন্যায়সঙ্গত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন, ইসলামিক শীর্ষ বৈঠক ও কমনওয়েলথ— সর্বত্র বাংলাদেশ সম্মানিত এবং সমাদৃত। প্রতিবেশী প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও বার্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি। এমনকি মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, সেইসব যুদ্ধাপরাধীকেও আমরা মার্জনা করে দিয়েছি। বাংলার মানুষের এ বদান্যতা ও ঔদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সাবেক পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বাটোয়ারা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়া পাকিস্তানের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছে না।

আরব ভাইদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনাময় এক নতুন দিগন্ত। দুর্দিনে তাঁরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সর্বনাশা বন্যার সময় তারা যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান; শোষিত, নির্যাতিত মানুষের সাথে একাত্মতা ও কারো প্রতি বৈরিতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্বের যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, আজ তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত | সংগ্রামী ভায়েরা আমার

একটি কথা আমি প্রায়ই বলে থাকি। আজও বলছি- সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। শোষিত, নির্যাতিত ও লুণ্ঠিত বাংলাদেশের সমাজদেহে সমস্যার অন্ত নেই। এই সমস্যার জটগুলিকে খুলে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না— চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এ অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি-না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্ম-সমালোচনা, আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি আপনার কর্তব্য দেশের ও দেশের জনগণের প্রতি কতটা পালন করেছেন, সেটাই বড় কথা।

আমি জানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিসের অসম্ভব মূল্য বৃদ্ধিতে আপনারা কী নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছেন। বিশেষ করে সীমাবদ্ধ আয়ের লোকদের দুঃখ-কষ্টে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। আমাদের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েক হাজার লোককে আমরা অনাহারের কবল থেকে বাঁচাতে পারিনি— এ সত্য স্বীকার করতে আমার কোনো লজ্জা নেই। কারণ আমি জানি, সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও একমাত্র আমরাই তখন এসব হতভাগ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সামান্য যা কিছু পেয়েছি, তাই নিয়ে এদের সেবায় এগিয়ে গিয়েছি। কিছুসংখ্যক ভাববিলাসীর ন্যায় বক্তৃতা-বিবৃতির ঝড় তুলেই ক্ষান্ত হইনি। খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে অনাহারে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি রোধ করার সুকঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

ভায়েরা আমার, জীবন ধারণের দুঃসহ সংগ্রামে অতীতের ন্যায় এবারেও আমি আপনাদের পাশে রয়েছি, ভবিষ্যতেও থাকব ।

আমাদের আজকের এই দুঃখ-কষ্ট যে নিতান্ত সাময়িক— সে সম্পর্কে আমি সুনিশ্চিত। এই বাংলায় সম্পদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তার সদ্ব্যবহারের জন্য সময়ের প্রয়োজন। আমরা যদি বাংলার এ সম্পদ বাংলার মাটিতে রাখতে পারি, সমাজতান্ত্রিক বিলি-বণ্টন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি এবং সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে কলে-কারখানায়, ক্ষেতে খামারে উৎপাদন বাড়াতে পারি, তবে ইন্‌শাল্লাহ আমাদের ভাবী বংশধরদের শোষণমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী এক ভবিষ্যৎ আমরা উপহার দিতে পারবো। আসুন, ১৬ ডিসেম্বরের এই পবিত্র জাতীয় দিবসে আমরা সেই শপথ গ্রহণ

করি।

খোদা হাফেজ

জয় বাংলা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ