সমাজতন্ত্রের পথ সুগম নয়, অনেক কঠিন পথ : বঙ্গবন্ধু

।। জগেশ রায় ।।
শুক্রবার, ২৭ মে, ২০২২

১৯ আগস্ট ১৯৭২, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

 

ভাই ও বোনেরা আমার,

ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমাকে আসতে হয়। অন্যথায় মনকে আমি সান্ত্বনা দিতে পারি না। বড় দুঃখের দিনে ছাত্রলীগের জন্ম। আপনাদের পক্ষে সেদিনের চিন্তা করাও কষ্টকর। ১৯৪৮ সালের কথা, যেদিন আজকের এই ছাত্রলীগের জন্ম হয় ফজলুল হক হলের কমনরুমে। সেদিন ছিল ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সাল। তখন দেশে বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হলো। সেইদিন বুঝতে বাকি রইল না যে, বাংলাদেশকে উপনিবেশ করার জন্য, বাংলার মানুষকে শোষণ করে গোলামে পরিণত করার জন্য তথাকথিত স্বাধীনতা এসেছে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৪৭ সালে কলকাতার পার্ক রোে সিরাজউদ্দৌলা স্টলে একটা ঘরোয়া বৈঠক করি। সেখানে আমার সহকর্মী কয়েকজন ছাত্রনেতাকে বলেছিলাম, ‘আমরা শেষ হয়ে গেছি। নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’

কলকাতা থেকে বিএ পাস করে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, বাঙালির জাত শেষ হয়ে গেছে। সেই শপথ নিলাম— বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে।

১৯৪৭ সালেই হলো আমাদের সংগ্রামের সূচনা। ১৯৪৮ সালে তারা আমার ভাষা ও আমার কৃষ্টির উপর আঘাত হানলো। বাংলা ভাষাকে ভুলিয়া আমাদের উর্দু ভাষা শেখানোর চেষ্টা হোক, জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এলেন। এই ময়দানেই বক্তৃতা করে জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন— উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। তার উপরে তখন কথা বলে এমন কার ঘাড়ে ক’টা মাথা ছিল? তবুও প্রতিবাদ করেছিলাম। এইখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল বাংলার ছাত্র সমাজ। প্রতিবাদ করেছিল বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ। অবশ্য জনগণের তখনও ঘোর কাটেনি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি গ্রেফতার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে। বলা বাহুল্য, সেদিন ছিল মহা দুঃখের দিন। রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আন্দোলন করতাম। সেদিন অক্টোপাসের মতো চারিদিক থেকে বাংলাকে এবং বাঙালিকে শেষ করার ষড়যন্ত্র চলছিল। ছাত্র ভাই-বোনেরা, অতএব, অতীতের এইসব কথা মনে করেই ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমাকে আসতে হয়। বহুদিন আমি বক্তৃতা করি না, আর বক্তৃতা করার ইচ্ছাও আমার নাই। তবুও যখন ছাত্রলীগের সম্মেলনের কথা শুনলাম, তখন অসুস্থতা সত্ত্বেও না এসে পারলাম না।

শোষণমুক্ত সমাজ না হলে সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে না

আমাদের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় রয়েছে ১৯৪৮-৪৯ সালের ধর্মঘট, ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, তার পরে ৯২(ক) ধারা আমলে ফজলুল হক সাহেব ও আমার গ্রেফতার। ১৯৪৮ থেকে ‘৫৮ সালের মধ্যে বহুবার কারাবরণ করেছি। তারপর এল ‘৫৮ সালে সামরিক আইন ও আইয়ুব খানের চোখরাঙ্গানি, ‘৬২ সালের গ্রেফতার, ‘৬৬ সালের ছ’দফা আন্দোলন, ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন, তারপরে স্বাধীনতার সংগ্রাম। একদিনে হয়নি। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। কিন্তু সব কিছু ম্লান হয়ে গেছে। ইতিহাসে এত রক্তের বিনিময়ে কোনো দেশ কোনো যুগে স্বাধীন হয়নি। এই ময়দানেই

বলেছিলাম- “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।” স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু মুক্তি পেয়েছি কি-না জানি না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি কি? বলা বাহুল্য, বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল। অর্থনৈতিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত জনগণের মুক্তি নিরর্থক। সে জন্য আমি আগেই বলেছি, সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু আজও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পাই নাই ৷ যতদিন এদেশের দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে না পারে, যতদিন অত্যাচার ও অবিচারের হাত থেকে তারা না বাঁচবে, যতদিন না শোষণমুক্ত সমাজ হবে, ততদিন সত্যিকারের স্বাধীনতা আসতে পারে না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আনতে যে ত্যাগের প্রয়োজন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আনতে তার চেয়ে বেশি কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। রাতারাতি হয় না। কোনোদিন হয়নি। বস্তুত এর কোনো সোজা পথ । ধীর পদক্ষেপে এগুতে হবে। এর জন্য অনেক ত্যাগের প্রয়োজন, অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন। একদিনে হয় না। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি এ সত্য বহুবার উপলব্ধি করেছি।

ভাইয়েরাবোনেরা আমার,

আজকে দেশের অবস্থা কী? এটা বোঝবার দরকার হয়ে পড়েছে আমাদের। আমি যদি আত্মবিশ্লেষণ করতে না পারি, আত্মসংযম না করতে পারি, আত্মশুদ্ধি করতে না পারি, তাহলে অন্যকে বলার আমার কোনো অধিকার নাই । ছোট ভাইয়েরা-বোনেরা আমার, সারাদিন কী করলে তা রাত্রে শোবার সময় একবার হিসাব-নিকাশ করো। আজ ভালো-মন্দ-এর হিসাব রাখলে পরের দিন এটা কাজে লগাবে। তাই বলি, তোমরা আত্মসংযম অভ্যাস কর; আত্মসমালোচনা কর, আত্মশুদ্ধি কর। তারপর পথে নামো। মানুষ শুনবে, মানুষ দেখবে, মানুষ শিখবে, শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে। মানুষও উৎসাহী হয়ে তোমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। কেউ কোনোদিন বলপ্রয়োগে ভালো কিছু করতে পারে নাই। স্বাধীন হবার পর আমি বলেছিলাম— তিন বছর কিছু দিবার পারব না। আমাকে সমর্থন করে জনগণ হাত তুলে বলেছিল– “কিছুই চাই না।’ কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন, আমি কি কিছুই দেই নাই? তবে কথা হলো, দেবার মতো অবস্থা থাকতে হবে।আপনারা জানেন যে, এক কোটি লোক দেশ ত্যাগ করে ভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। দেশের মধ্যে দেড় কোটি লোক পালিয়ে বেড়াল। ৩০ লক্ষ লোক জান দিল। স্কুল-কলেজ ভেঙে দিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হলো। কল-কারখানা নষ্ট করে গেল। লক্ষ লক্ষ ছেলে অক্ষম হয়ে গেল। তাদের হাত নাই, পা নাই । মা-বোন পিতৃহারা, সন্তানহারা হয়ে গেল। এই হচ্ছে বিপ্লবের পরের বাংলাদেশ। এই অবস্থায় পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরলাম।

সমাজতন্ত্রের পথ সুগম নয়অনেক কঠিন

রুশ বিপ্লবের ইতিহাস আপনারা জানেন। পড়ুন রাশিয়ার ইতিহাস। বিপ্লবের পরে কতো বৎসর পর্যন্ত সেখানকার লোক কষ্টে দিন কাটিয়েছে। সমাজতন্ত্রের পথ সুগম নয়। অনেক কঠিন পথ। সমাজতন্ত্রের সুফল ভোগ করতে অনেক সময় লাগে। বিপ্লবের প্রায় ৫০ বৎসর পর সোভিয়েত রাশিয়া সমাজতন্ত্র কায়েম করেছে। ২৫ বৎসর ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়েছে। আজও সেখানে দুর্ভিক্ষ, মহামারী আমেরিকা দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। সেখানে আজও বহু সমস্যা তাদের আছে। দুনিয়ার ইতিহাস দেখুন। আজ ৯ মাস স্বাধীনতা পেয়েছি। রেললাইন ভাঙা, রাস্তা ভাঙা, ছাত্রদের কলেজ, স্কুল নাই। বই-খাতা নাই। গুদামে খাবার নাই। সব নষ্ট। সাড়ে সাত কোটি মানুষ অধ্যুষিত ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার এই দেশে ওরা চালিয়েছিল মহা ধ্বংসযজ্ঞ। তবুও আল্লাহর কাছে শোকর করা উচিত যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ ছিল একটি উপনিবেশ। এখানে প্রতিরক্ষার কোনো অফিস ছিল না। এখানে পরিকল্পনা কমিশনের অফিস ছিল না। এখানে আমদানি, রপ্তানির কোনো অফিস ছিল না। যা ছিল দু’চার-পাঁচ জন কর্মচারী নিয়ে। তা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার একটা কানাকড়িও ছিল না। ভারতবর্ষ, রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন– সকলকেই আমার বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দাবি করতে চাই। তবে কাউকে আমি আমার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে দিতে চাই না। আজ কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল অযথা ভারতবিরোধী বিষ উদগীরণ করে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি শেখ মুজিবুর রহমান তো বাংলার মাটিতেই ছিলাম। আমি তো সেখানে যেয়ে ৪৭ হাজার টাকা খাই নাই। যুদ্ধের পর আড়াই কোটি মণ খাবার ভারতবর্ষ আমাকে দিয়েছে। যে জন্য মিসেস গান্ধীর সরকারকে আজ খাদ্য সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ খাবার না দিলে আমার বাংলার মানুষ বাঁচতো না। সে আমার প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সুখে থাকুক। আমি বাংলাদেশ, সুখে থাকি। সে আমার ভাই, আমি তার ভাই, পাশাপাশি থাকি। যদি আমার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করে তবে কেমন করে তার মোকাবিলা করতে হয় তা শেখ মুজিবুর রহমান জানে। আমার বাংলার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে দুনিয়াতে এমন কোনো শক্তি নাই। কিন্তু অহেতুক খুঁচিয়ে কারো সাথে সম্পর্ক তিক্ত করতে চাই না। কারণ আমরা দুনিয়ার সকলের বন্ধুত্ব চাই। দুর্দিনে রাশিয়া আমাদের সাহায্য করেছে, ভারতবর্ষ সাহায্য করেছে। দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সাহায্য করেছে। বৃটেন ও আমেরিকার জনগণ আমাদের সাহায্য করেছে দুনিয়ার সকল প্রগতিশীল মানুষ আমাদের সাহায্য করেছে। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমরা কামনা করি। কারো সঙ্গে আমার শত্রুতা নাই।

আপনারা জানেন যে, অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা এক কেটি ৩০ লক্ষ, আর আয়তন ভারতবর্ষের আড়াই গুণ। কানাডার লোকসংখ্যা ২ কোটি, আয়তন হচ্ছে ২ লক্ষ বর্গমাইল। আর বাংলাদেশের আয়তন ৫৪ হাজার বর্গমাইল। সেদিন কানাডায় কমনওয়েলথের ৩২টি দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক বসলো। ভারতবর্ষের লোকসংখ্যা প্রায় ৫৬ কোটি আর আমার হলো সাড়ে সাত কোটি, নাইজেরিয়ার ৬ কোটি আর অন্যান্যদের কোনোটার দেড় লাখ, কোনোটার আড়াই লাখ, কোনোটার ১৫ লাখ, কোনোটার ৪০ লাখ ইত্যাদি। আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমরা আমার সাড়ে সাত কোটি থেকে তিন কোটি লোক কোনো এক দেশে নিয়ে নাও। অবশিষ্ট সাড়ে চার কোটি লোকের জন্য আমার কোনো সাহায্য লাগবে না। বরং দু’তিন বছর পরে আমিই তোমাদের সাহায্য দিতে পারব।

কিছুদিন আগ পর্যন্ত শ্রমিকেরা কল-কারখানায় কাজ করত না। এখন কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। তাদেরকে আমি ধন্যবাদ দিই। আরো একটু ভালো কাজ করুন। যত আয় করবেন, যত উৎপাদন বাড়াবেন ততই আপনাদের লাভ। আর যদি না করেন তবে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে ।ছাত্র ভাইয়েরা, দেশের যেদিকে তাকাই সেদিকেই চোর দেখি। চোরের জ্বালায় আমি অস্থির। যার উপর কোনো কাজের ভার দিই, সে-ই চুরি করে, বিলাত চলে যায়। সেই জন্যই বলেছিলাম- সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষের দরকার। তাহলেই সোনার বাংলা গড়তে পারব। তা না হলে শেখ মুজিবুরকে বেটে খাওয়ালেও পারা যাবে না। আফসোস তো সেখানেই! কিছুসংখ্যক লোক আছে যেখানে পায় সেখানে চাড়া দেয়। এখন প্রয়োজন জনমত সৃষ্টি করা। বাংলার ছাত্র সমাজ, এ কাজ তোমরা পার। তোমাদের নিয়ে আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ করেছিলাম। যারা আগে ছাত্রলীগ করত তারা জানত যে, আমি কী চাই? তাদের সঙ্গে নানা পরামর্শ করে আন্দোলন করতাম। তারা আমার নির্দেশ মতো কাজ করত। তাই বলি, এখনও সংগ্রাম শেষ হয় নাই; শুরু হয়েছে মাত্র। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শৃঙ্খলার প্রয়োজন। অনেকে বিদেশে দেখে এসেছে শৃঙ্খলাবোধ কাকে বলে। কিন্তু আমার এখানে তো সব ফ্রি স্টাইল। বহুদিন বলব বলব করে বলিনি। কিন্তু আজ দুঃখের সাথে একটা কথা বলতে চাই- হয় আমাকে প্রধানমন্ত্রীর গদি ছাড়তে হবে, আর না হয় চরম আঘাত করতে হবে।

একদিকে গণতন্ত্রের বুলিঅন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের হুমকি

প্রধানমন্ত্রীর গদির জন্য আমি রাজনীতি করি নাই- তা তোমরা জানো। বার বার প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ আমি পেয়েছি। আদর্শের প্রশ্নে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে রাজি হয়েছি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব নেই নাই। আমি জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু। আমি প্রধানমন্ত্রী কেন হবো? কিন্তু হয়েছি এই জন্য যে, জনসাধারণের পেটে খাবার নাই। দুনিয়া থেকে খাবার আনতে হয়। ৩৮ লক্ষ টন খাবার আনতে হয়েছে বিদেশ হতে। অনেকেই বক্তৃতা করে আমাদের স্বাধীনতা নাই। আবার তা খবরের কাগজে ওঠে। বলে- সশস্ত্র বিপ্লব করব। তাও খবরের কাগজে লেখা হয়। তার পরেও বলে, আমাদের স্বাধীনতায় হাত দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানে ও ভারতবর্ষে আজও ইমারজেন্সি আছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এবং এই সরকার মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। অতি সীমিত। সময়ে দেশকে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এটা যদি পাপ হয়, তবে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বৈকি! কাগজে লেখা হয়, অমুক তারিখের মধ্যে যদি দাবি মানা না হয় তবে অমুক তারিখ থেকে শসস্ত্র বিপ্লব করব। এ থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই— এটা কি প্রমাণ হয়? আমি গণতান্ত্রিক দুনিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করতে চাই। তবে এরও একটা নীতিমালা আছে ৷ একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকারের বুলি অন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের হুমকি— এ দুটো এক সাথে চলে না। যারা আন্দোলনের ভয় দেখায়, তারা জানে না, আমি আন্দোলনের মধ্যে পয়দা হয়েছি। দরকার হলে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত পরিণতিতে যাব, কিন্তু অন্যায় সহ্য করা হবে না। আমরা বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছি। আমার জনগণ আমার কথায় অস্ত্র জমা দিয়েছে, আর কারও কথায় দেয় নাই। অনেকে বলে, বঙ্গবন্ধু, তুমি কঠোর হও। কিন্তু কঠোর হওয়ার পরিবর্তে আমি ক্ষমা করেছি, ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার চেষ্টা করেছি। এটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে তবে তার প্রতিবিধান আমাকে করতে হবে। কে বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়েছিল, কে দখলদার সরকারের হুকুম মানছিল, কে এখানে চাকরি করেছে, কারা কারা এখানে ব্যবসা করেছে— সবকিছুরই রেকর্ড আছে। তবুও এরা বাংলার মানুষ বলেই ক্ষমা করেছি। স্বাধীনতার পর আর রক্তপাত আমি দেখতে চাই নাই। কিন্তু তাই কি হচ্ছে? আমার কর্মীরা মারা যাচ্ছে। তারা আমাকে অস্ত্র ফেরত দিয়েছে। তাদেরকে আমি রক্ষা করতে পারছি না। রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতকারীর দল তাদের হত্যা করছে। তারা আজ এসে বলে, ‘মুজিব ভাই, তুমি আমার অস্ত্র নিয়ে গেছ। তুমি আমার অস্ত্র ফেরত দাও, দেখি আমার গায়ে কে হাত দেয়! আমি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। তারা আমার কথায় অস্ত্র ফেরত দিয়েছে। আর দুষ্কৃতকারীরা রাতের অন্ধকারে সেই কর্মীদের হত্যা করে। তারা বাইরে এসে বন্ধুর মতো আলাপ করে, আর ভিতরে ভিতরে অস্ত্র শানায়। এরা কারা— আমরা জানি না? বাংলাদেশে এমন কোনো মহকুমা নেই, এমন কোনো থানা নেই, যেখানে আমি যাইনি। এমন কোনো লোক নেই যার পাশে দাঁড়িয়ে আমি আন্দোলন করি নাই। আমার জীবনের একটা বড় অংশ কারাগারে কেটেছে বাংলাদেশের মানুষের জন্য। আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণে একটা গুলি আমি ছাড়ি নাই। ১৪৪ ধারা জারি করি নাই। সবাইকে বলেছি– ভাইয়েরা, আমি জাতির পিতা, আমি বঙ্গবন্ধু; আমার দ্বারা কী করে এসব সম্ভব?যা আছে ভাগ করে খান

গত ২৫ বছর ধরে বেতন কমিশনের বহু মহড়া আপনারা দেখেছেন। কিন্তু কাজের বেলায় ঠন্‌ঠন্‌। কিন্তু আমি বেতন কমিশন দিয়েছি। কমিশন যা সুপারিশ করেছে তাতে মাইনে বাবদ আরো ৪২ কোটি টাকা দিতে হবে বৎসরে। খাবার কিনতে হবে, তেল কিনতে হবে, কাপড় কিনতে হবে, ওষুধ কিনতে হবে। শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ কিনতে হবে। কারখানা চালাতে হবে, আবার বেতনও বাড়াতে হবে। টাকা আসবে কোথা থেকে? ট্যাক্স করে? ট্যাক্স কাকে করব? এ দেশের দুঃখী মানুষের উপর? যার পরনে কাপড় নেই, পেটে খাবার নেই, তাদের উপর? প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিব, তবুও ঐ গরিবের হাড়ের উপর ট্যাক্স বসাতে আমি পারব না। যা আছে ভাগ করে খান। এসব সত্ত্বেও গরিব কর্মচারীদের যে বেতন সুপারিশ করা হয়েছে তাই দিয়েছি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও অফিসে মনে হয়। একেবারে ফ্রি স্টাইল চলছে। যখন খুশি আসেন, যখন খুশি যান। মনে করেছে, সরকার কিছু কয় না। বঙ্গবন্ধু আছে, একবার কেঁদে-কেটে পড়লে মাফ করে দেবে। অনেক সময় মাফ করে দিয়েছিও। কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। তাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের পয়সা আপনারা খাচ্ছেন। আর জনগণের পয়সায়ই যখন খান তখন জনগণের একটু উপকার করেই খাওয়া উচিত।

বেতন কমিশনের মতো শিক্ষা কমিশন করেছি। প্রাথমিক রিপোর্ট পেয়েছি। চূড়ান্ত রিপোর্ট আসুক। শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। সমাজতন্ত্রের রূপায়ণে কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন এবং এই ব্যবস্থা কার্যকরী করতে কী পরিমাণ অর্থের দরকার, এটা বিবেচনা করে শিক্ষা কমিশন একটা চূড়ান্ত সুপারিশ করবেন। তারপর সব হবে। গতবার পরীক্ষার তিনদিন আগে শিক্ষকরা ধর্মঘটের নোটিশ দিলেন। আমি ডেকে এনে শিক্ষকদের বললাম যে, পরশু পরীক্ষা; আপনারা ধর্মঘটের নোটিশ দিলেন কীভাবে? তাঁরা বলেন যে, আমাদের এই সামান্য জিনিস দিতে হবে। আমি বললাম, আমি দেব। আপনারা এদের পরীক্ষা নষ্ট করবেন না। এবারও ঠিক পরীক্ষার সময় স্ট্রাইক করে বসলেন। দায়িত্ব যেমন আমাদের আছে, তেমন আপনাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। এ দেশের ছেলে-মেয়েরা আপনাদের সন্তান। আপনারা স্ট্রাইক করেন এভাবে? সকল কলেজ এক সাথে ন্যাশনালাইজ করলে যত টাকার দরকার হবে তত টাকা আসবে কোথা হতে? ধাপে ধাপে এগুতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাইমারি স্কুলে করেছি। এরপর আসবে মাধ্যমিক স্কুল। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সবকিছুর মূল্যায়ন করে একটা ব্যবস্থা নিত হবে । এত টাকা আসবে কোথা হতে? টাকার জন্য বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশকে আমি মর্টগেজ দিতে পারবো না। পারবো না এ দেশের গরিবের হাড্ডির উপর ট্যাক্স বসিয়ে টাকা এনে দিতে আপনাদেরকে আপনারা ভুল করেছেন। ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে ওয়াদা আদায় করতে পারবেন না। এটা আমি শিখি নাই। তা যদি হতো তবে স্বাধীনতা আন্দোলনকালে ইয়াহিয়া খান যখন আমার কবর তৈরি করে আমাকের ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যায়, তখন আমার মুখ থেকে একটা কথা বের করতে পারত। তা পারেনি। কারণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে আমি অপমান করে যেতে পারি না, যাদের পিতা আমি।

দুঃখের কথা এই যে, পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের পরীক্ষার নকল বন্ধ করতে হয়। এ কথা কার কাছে বলব? এই দুঃখ বলার জায়গা আছে আমার? দোহাই আল্লাহর। নকল বন্ধ করার জন্য আর যেন আমার পুলিশ নিতে না হয়। তোমরা নিজেরাই মিলে-মিশে নকল বন্ধ কর। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এক সাথে হয়ে যেমন সংগ্রাম পরিষদ করেছে তেমনি তোমরা মিলে-মিশে এই সমস্যার সুরাহা কর। তোমাদের আমি সাহায্য করব। পুলিশ দিয়ে নকল বন্ধ করতে যেন না হয়।

ভাইয়েরা-বোনেরা আমার দেশে একদল লোক সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। জীবনভর আমি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, রক্ত দিয়েছে একটা আদর্শের জন্য। জাতীয়তাবাদ, যা তোমরা বিশ্বাস কর, এটা হলো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা বাংলার বৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া, তাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তা তোমরা কর শোষণহীন সমাজ, সুষম বণ্টন, সম্পদের মালিক জনগণ, তোমরা তা বিশ্বাস কর। এই লক্ষ্যে পৌছবার কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। আস্তে আস্তে যেতে হবে।গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে রাখা দরকার যে, গণতন্ত্রের একটা নীতিমালা আছে। গণতন্ত্রের দিশারী যারা তাদের গণতন্ত্রের নীতিকে মানতে হয়। খালি গণতন্ত্র ভোগ করবেন আর নীতিমালা মানবেন না- ওটা হবে। না, হতে পারে না। ছোট ভাইয়েরা আমার, যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে হলো বন্য জীবের সমতুল্য। তা সত্ত্বেও অনেককে ক্ষমা করা হয়েছে। কিন্তু আজ সুযোগ পেয়ে যারা বাংলার গ্রামে গ্রামে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন শুরু কর। ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা সমুন্নত রাখো। যে আদর্শে বিশ্বাস করে তোমরা রক্ত দিয়েছ, সে আদর্শের পথ হতে তোমরা বিচ্যুত হয়ো না।

বাটপারদের উৎখাতের জন্য গণআন্দোলন দরকার

জনসংখ্যাজনিত সমস্যাটি আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একটা কথা তোমাদের মনে রাখা উচিত- ৫৪ হাজার বর্গমাইল জায়গায়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ। এই সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। নদীর মাছ যা আছে সবই কিন্তু খেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরের বছর অতগুলো পাবে না। দাম বাড়বে। জমির ফসল উৎপন্ন করলে তো খাওয়া বাড়বে। সেজন্য ফসল উৎপাদন বাড়াতে বলছি। তোমরা একটা করে গাছ লাগাতে পার না? একটা লাউ গাছ, একটা কলা গাছ, একটা আম গাছ, একটা কাঁঠাল গাছ লাগাতে পার না? জনসংখ্যা তো বেড়েই চলেছে দিন দিন। সেই তুলনায় জায়গা তো অল্প ফসল উৎপাদন না করলে তোমরা দেশকে বাঁচাতে পারবে না। মনে রেখ, এভাবে যদি লোকসংখ্যা বাড়ে তবে ২৫ বছর পর মানুষের মাংস মানুষ খাবে। সাড়ে সাত কোটি লোক বেড়ে যদি ১৫ কোটি হয়, তবে ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকায় থাকার জায়গাও হবে না। সেই জন্য মানুষ পয়দা কম করে, সাথে সাথে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কাজ কর, দেশে এখন চোর-ডাকাতের উপদ্রব। তোমরা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মিলে-মিশে যেভাবে এখানে সংগ্রাম পরিষদ করেছ, ঠিক তেমনি প্রতিরক্ষা কমিটি কর। আমি আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপকে বলেছি সংঘবদ্ধ হয়ে গ্রামে গ্রামে প্রতি ইউনিয়নে প্রতিরক্ষা পার্টি গঠন করার জন্য। দেশ থেকে চোর- বাটপারদের উৎখাত করতে গণআন্দোলনের দরকার। আমি তো বলেছি, তোমাদের কোনো চিন্তার কারণ নাই। নিশ্চিন্ত থাকতে পার। বাংলার দুঃখী মানুষের যদি আবার দুর্দিন আসে আর তাদের জন্য কিছু না-ই করতে পারি, তবে ঠিক তোমাদের নিয়ে আমি আবার রাস্তায় নামব। এদেশের মানুষের ভালোবাসার জন্য আমি সব ছাড়তে পারি, সব ত্যাগ করতে পারি।

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ছোবল মারবে

এক দল লোক আছে যারা আবার বড় বড় বক্তৃতা করে। চুরি করে, হাইজ্যাকের গাড়িতে চড়ে। ঢাকায় বাড়ি করে থাকে। উপার্জনের কোনো হদিস নাই। কোথেকে পয়সা পায়, কোথেকে খায়, বড় গাড়িতে চড়ে, বড় বাড়িতে থাকে। আর অন্যদিকে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা করে। সেই জন্য বলছি, আত্মত্মসমালোচনা করে আত্মসংযম অভ্যাস কর। তাহলে মানুষ হতে পারবে। তোমাদের ছাত্রলীগ বড় সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান। অনেকবার এর মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছে। পরগাছা অনেক বের হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয় নাই। বিপ্লবের পরে কয়েকটা বছর বড় সাংঘাতিক যায়। এই সময়ে যদি তোমরা যুবসমাজ, ছাত্রসমাজ হুঁশিয়ার না থাক, তবে স্বাধীনতার শত্রুরা মাথা তুলে উঠে এমন ছোবল মারবে যে, আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। স্বাধীনতার শত্রুরা আজ সংঘবদ্ধভাবে দেশের ভিতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। যুবসমাজকে যেমন আগে ডাক দিয়েছিলাম, তেমনি আজও ডাক দিয়ে যাই তোমরা বিপদমুক্ত হও নাই। তোমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য, তোমাদের ঈপ্সিত সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যকে বানচাল করার জন্য, তোমাদের আদর্শকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুরা চারিদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে। তোমরা সংঘবদ্ধ থাকলে ওদের কীভাবে ঠাণ্ডা করতে হয় তা ইনশাআল্লাহ আমি জানি।

বাবারা একটু লেখাপড়া শিখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ কর, ঠিকমতো লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু থাকে বাপ-মাকে সাহায্য কর। প্যান্ট পরা শিখেছো বলে বাবার সঙ্গে হাল ধরতে লজ্জা করো না, কোদাল মারতে লজ্জা করো না। দুনিয়ার দিকে চেয়ে দেখ। কানাডায় দেখলাম ছাত্ররা ছুটির সময় লিফট চালায়।

ছুটির সময় দু’পয়সা উপার্জন করতে চায়। আর আমাদের ছেলেরা বড় আরামে খান, আর তাস নিয়ে ফটাফট খেলতে বসে পড়েন। গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুন গাছ লাগিও, কয়টা মরিচ গাছ লাগিও, কয়টা লাউ গাছ ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগিও। বাপ-মারে একটু সাহায্য কর। কয়টা মুরগি পালো, কয়টা হাঁস পালো। জাতীয় সম্পদ বাড়বে। তোমার খরচ তুমি বহন করতে পারবে। বাবার কাছ থেকে যদি এতটুকু জমি নিয়ে ১০টি লাউ গাছ, ৫০টা মরিচ গাছ, কয়টা নারিকেল গাছ লাগায়ে দাও, দেখবে ২/৩ শত টাকা আয় হয়ে গেছে। তোমরা ঐ টাকা দিয়ে বই কিনতে পারবে। কাজ কর, কঠোর পরিশ্রম কর, না হলে বাঁচতে পারবে না। শুধু শুধু বিএ,এমএ পাস করে লাভ নাই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুল, যাতে সত্যিকার মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে। কেরানী পয়দা করেই একবার ইংরেজ শেষ করে গেছে দেশটা। তোমাদের মানুষ হতে হবে। আমি কিন্তু সোজা সোজা কথা কই, রাগ করতে পারবে না। বুড়া হয়ে গেছি। রাগ কর আর যাই কর আমার কথাগুলো শোনো। লেখাপড়া কর আর নিজেরা নকল বন্ধ কর। এই ঘুষ— দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতির বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে থানায় থানায় সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোেল। প্রশাসনকে ঠিকমতো চালাতে সময় লাগবে। এর একেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত গলদ আছে। মাঝে মাঝে ছোট-খাট অপারেশন করছি। বড় অপারেশন এখনও করি নাই। সময় আসলে করা যাবে। তোমাদের আমি এইটুকু অনুরোধ করছি, তোমরা সংঘবদ্ধ হও। আর মেহেরবানী করে আত্মকলহ করো না। এক হয়ে কাজ কর। দেশের দুর্দিনে স্বাধীনতার শত্রুরা সংঘবদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা দলবদ্ধ। তোমাদের সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে দেশকে রক্ষা করতে হবে।

আমি ৪৬ জন এমসিএ কে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেছি। অন্য কোনো পার্টি জীবনে তা করে নাই। কিন্তু যারা বড় বড় কথা বলে তাদের আয়নার দিকে চেয়ে কথা বলতে হবে। না হলে অন্যায় হবে। সেই জন্য আজ আত্মসমালোচনা করে নিও। বাঙালিরা স্বাধীনতা ভোগ করে নাই বহুকাল। স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে আগে জানতে হবে স্বাধীনতার মর্ম কী? তাই ছাত্র ভাইয়েরা ও বোনেরা, তোমাদের কাছে আমার আবেদন রইল, মানুষের মতো মানুষ হও। স্বাধীন দেশের নাগরিক হও। মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। মিথ্যা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। তোমরা সুখী হও। ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ ।

জয় বাংলা ।

মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখি।—বঙ্গবন্ধু

সূত্রঃ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ– শেখ হাসিনা


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ