জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১৬ জুলাই, ১৯৭২ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উদ্ধৃতাংশ
মাননীয় সভাপতি, সুধীবৃন্দ ও সাংবাদিক ভায়েরা,
আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম।
আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও ছিলেন। আমি অনেকদিন তাঁদের সঙ্গে জেলখানায় কাটিয়েছি। এবারের সংগ্রামে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা আজ আমাদের মধ্যে নাই। তেমনি নাই ৩০ লক্ষ লোক, যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। তাঁদের কথা চিরদিন আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে এবং যে আদর্শের জন্য তাঁরা জীবন দিয়েছেন, সে আদর্শে যদি বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়, তাহলে তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে।
স্বাধীনতার পটভূমি
সাংবাদিক ভাইদের কাছে আমার কয়েকটা স্পষ্ট আরজ আছে। আপনারা জানেন, বিপ্লবের মাধ্যমে এই স্বাধীনতা এসেছে এবং সে বিপ্লব ছিল। রক্তক্ষয়ী। এমন বিপ্লবের পরে কোনো দেশ কোনো যুগে এতটা স্বাধীনতা
ভোগ করতে পারে নাই, যা আমরা করছি। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। এজন্য আপনাদের কোনো কাজে কখনো কোনো হস্তক্ষেপ করি নাই। যদিও নৃতন বাংলাদেশ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ। বিপ্লবের পূর্বেকার সরকার একটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মতো ছিল। আর যারা এদেশে ছিলেন, জাতীয় সরকার কী করে চালাতে হয় সে বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাদের তাই নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। শুধু মুক্তিবাহিনীর ভায়েরাই অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করে নাই। জনগণকেও লড়তে হয়েছে স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে। হানাদার বাহিনী যাওয়ার সময় আমাদের স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গেছে। আমাদের কাছে এর দলিল আছে। শত্রুদের বিচারের সময় আপনারা সেসব দলিল দেখতে পাবেন।
সাংবাদিকতার আদর্শ
আপনারা খবরের কাগজের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি এবং এইসব আদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে- এটাও আপনারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন। আমরা এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতেই দেশের শাসনতন্ত্র তৈরি করতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্রে একটা মূলনীতি আছে। গণতন্ত্রের অর্থ পরের ধন চুরি, খুন-জখম, লুটতরাজ বা পরের অধিকার হরণ করা নয়। তার জনকল্যাণমূলক একটা নীতিমালা আছে। সাংবাদিকতারও এমনি একটা নীতিমালা আছে। আমরা জানি, সাংবাদিকদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যাঁরা সামরিক চক্রের হীন কাজে সহায়তা করেছেন। তাঁরাই ধরিয়ে দিয়েছেন সেইসব সাংবাদিকদের, যারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। এই তথাকথিত সাংবাদিকদের একজন কোনো দৈনিক কাগজে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি আলবদরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন। এমন সাংবাদিকও আছেন, যাদের এই ধৃষ্টতামূলক কাজের নজির আমাদের কাছে আছে। তারা হানাদার বাহিনীকে সংবাদ সরবরাহ করতেন। কিছু কিছু সাংবাদিক নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করতেন। কিন্তু তারা স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যান্টনমেন্টে খবর সরবরাহ করতেন।আপনারা কি বলবেন যে, তাদের গায়ে হাত দিলে গণতন্ত্র এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার উপর আঘাত করা হবে?
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
যিনি একদিন দৈনিক পয়গাম চালাতেন, তিনি যদি আয় উপার্জনহীন কোনো ব্যক্তির আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি একখানি দৈনিক কাগজ বের করেন, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে— তার এই মালিকের টাকা কোথেকে এল? এরপর আবার এই রাতারাতি গজিয়ে ওঠা মালিক-সাংবাদিক সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখতে আরম্ভ করলেন। আপনারা দাবি করেছিলেন, আপনাদের পূর্ণ স্বাধীনতায় যেন কোনোদিন হস্তক্ষেপ না করি। কিন্তু আপনাদেরও দায়িত্ব আছে। আপনাদের সাংবাদিক ইউনিয়নের যে আদর্শ আছে, সেগুলি মানলে কি মিথ্যা কথা লেখা যায়? রাতারাতি একটি কাগজ বের করে বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে কেউ যদি বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে, তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই সেটা সহ্য করবেন না। কারণ, তা আমাদের স্বাধীনতা নষ্ট করবে। ‘ওভারসীজ পাকিস্তান’ নামে কোনো সংস্থা যদি এখান থেকে খবরের কাগজ প্রকাশ করে, তাহলে আমাকে কী করতে হবে? আপনারা সামান্য কিছু লোকের স্বার্থ দেখবেন না সাড়ে সাত কোটি লোকের স্বার্থ, যে ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে, তাঁদের স্বার্থ দেখবেন? বিপ্লবের পরে সংবাদপত্র যে স্বাধীনতা পেয়েছে, তা এদেশে আর কখনো ছিল না। এই জন্যই রাতারাতি খবরের কাগজ বের করেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ ছাপানো হয়— ‘এক লক্ষ বামপন্থী হত্যা’ ‘বিমান বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ’ ইত্যাদি। কিন্তু এসব কি লেখা উচিত? এবং এসব কার স্বার্থে ছাপানো হয়?
সংবাদপত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা
আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন। আমিও বলি। কিন্তু কোনো কোনো খবরের কাগজে এমন কথাও লেখা হয়, যা সাম্প্রদায়িকতার চরম। অথচ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে চব্বিশটি বছর প্রগতিশীল সাংবাদিকরা সংগ্রাম করেছেন। আমরা সংগ্রাম করেছি, বাংলার মানুষ সংগ্রাম করেছে। আমাদের ছেলেরা, কর্মীরা জান দিয়েছে, জেল খেটেছে। সে নীতির বিরুদ্ধে যদি কোনো সাংবাদিক লেখেন তাহলে আপনারা কী করবেন? এটাও আপনাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
একখানা কাগজে লেখা হয়েছে, ‘গণহত্যা চলছে’। গণহত্যার কথাই যদি বলেন, তবে আমি আপনাদের বলব যে, এ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় বহু আওয়ামী লীগ কর্মী আর প্রগতিশীল কর্মী মারা গেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর গণহত্যা হয় নাই। এ জন্যে দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এত বড় বিপ্লবের পরে, হানাদারদের দ্বারা সংঘটিত এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরেও যে আর একটা হত্যাকাণ্ড হয় নাই, তাঁর জন্য বাংলার মানুষ ও প্রগতিশীল কর্মীদের আপনারা নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানাবেন।
ভারতীয় চক্রান্ত?
অনেকে ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলে থাকেন। যারা আমাদের দুর্দিনে সাহায্য করেছে তারা নাকি আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পকেটে ফেলে রাখবার চেষ্টা করছে। এ ধরনের কথা বলা কি সাংবাদিকতার স্বাধীনতা? এর নাম কি গণতন্ত্র?
যদি কেউ অনাহারে মরে থাকে, আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন। তার জন্য আমিও দায়ী হব। আমি চেষ্টা করছি, যাতে কেউ অনাহারে না মরে। যদিও দেশে খাবার নাই। আমাদের খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩০ লক্ষ টন। আমি বিদেশ থেকে ১৭ লক্ষ টন এনেছি। ভারত সাড়ে ৭ লক্ষ টন খাবার দিয়েছে। এছাড়া ‘আনরড’ এবং ইউএসএ, কানাডা ও রাশিয়া থেকেও খাবার পাওয়া গেছে। সাধ্যমতো সবাই আমাদের সাহায্য করছে। এর ভিতর ভারতীয় চক্রান্ত কোথায়? অথচ কোনো কোনো খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে ৫০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য ভারতে পাচার’, ‘আমরা কি সত্যিই সার্বভৌম’ ইত্যাদি ।
দালাল সাংবাদিক
অনেক কাগজের শিরোনামা আমার কাছে আছে। এই কাগজগুলো ফরমান আলী খানের দয়ায় ঢাকায় বসে নয় মাস কাজ করেছে, কিন্তু তাদের আজও ছোঁয়া হয় নাই ৷ অনেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক মা-বোন-বউ ঘরে ফেলে অকূল পাথারে ভেসে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ফরমান আলীর অনুগ্রহভাজনরা এখানে বসে আরামে খবরের কাগজ চালান এবং হানাদারদের সাথে সহযোগিতা করেন। এরপর স্বাধীনতা পেয়ে তারা রাতারাতি বিপ্লবী হয়ে গেলেন। তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে লেখেন। তাদের সরকার ক্ষমা করতে পারে, জনগণ ক্ষমা করবে কি-না সন্দেহ আছে। সরকারের যেমন স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আছে, তেমনি নীতি পালনের দায়িত্ব আছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও আছে।আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না। অথচ কোনো কাগজে লেখা হয়েছে- ‘মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও।’ যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে এখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চান তাহলে তা কি আপনারা সহ্য করবেন? আপনাদের যে কোনো কথা বলবার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আপনাদের একটা নীতিমালাও রয়েছে।
স্বাধীনতা উত্তরকালের সঙ্কট
স্বাধীন দেশে যথেচ্ছাচার চলতে দেওয়া যেতে পারে না। স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার তারই আছে, যে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে জানে। আপনাদের অনেক দাবি ছিল। সেসব দাবি আমরা সব সময়ই সমর্থন করেছি। আর গত ছয় মাসে কোনো দাবিই পূরণ করা হয় নাই, এমন কথা কেউ আমাদের বলতে পারবেন না। আমাদের পোর্ট বন্ধ। আমাদের রাস্তা নাই— গুদামে চাল নাই । এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রাও নাই। রাজস্ব আদায় নাই৷ তবু আমাদের সরকার চালাতে হয়েছে। আইন এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে হয়েছে। এর মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৮০টা দেশের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। আমরা জাতিসংঘের এবং অন্যান্য সংস্থার সদস্যও হতে যাচ্ছি। স্বাধীনতা লাভের সময় আমাদের হাতে কী ছিল? তখন পররাষ্ট্র দপ্তর বলতে কিছুই ছিল না। বাংলাদেশে দেশরক্ষা দফতর ছিল না। অর্থ দপ্তরটিও একটি নেজারাতের মতো ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা ছিল শোচনীয়। স্কুল কলেজের অবস্থাও ছিল তথৈচ। মোট কথা, স্কুল-কলেজ ভাঙা ছিল। আমাদের সবকিছুই ছিল বিধ্বস্ত। এমন দেশ নেই যেখানে বিপ্লবের পরে দুই-চারবার দুর্ভিক্ষ হয় নাই। কিন্তু আমরা পর্যাপ্ত খাবার দিতে না পারলেও বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের প্রতিটিতেই কিছু না কিছু খাবার পৌছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি ৷
আমরা অনেকগুলি কমিশন গঠন করেছি। এবং সুষ্ঠুভাবে কাজ করবার জন্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। আমরা যে সমস্ত কমিশন গঠন করেছি, সেগুলির মধ্যে রয়েছে শিক্ষা কমিশন, বেতন কমিশন। শীঘ্রই বেতন বোর্ড, চাকরি পুনর্বিন্যাস কমিশনও গঠন করা হবে।
স্ক্রিনিং
সরকারি কর্মচারীদের স্ক্রিনিং করার জন্য স্ক্রিনিং কমিটি করা হয়েছে। যারা দালালি করেছে, তাদের বিষয় স্ক্রিনিং কমিটিতে আসবে এবং কমিটির বিচার-বিবেচনার ফলাফল খবরের কাগজে দেওয়া হবে। যাদের উপর আপনাদের আস্থা আছে সে সমস্ত লোক নিয়েই কমিটি গঠিত হয়েছে। তাঁদের ভিতর হাইকোর্টের জজও রাখা হয়েছে। যাতে কেউ বলতে না পারেন, রাজনৈতিক কারণে আমি আওয়ামী লীগ ও তার বন্ধু দলগুলোকে বাদ দিয়ে কেবল অন্য দলের লোকদের স্ক্রিনিং করছি ।
বিশ্ববিদ্যালয়েও স্ক্রিনিং চলছে। তবে, তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন রয়েছে। এজন্য স্ক্রিনিং সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেবেন। আমাকে বলা হয়েছে, সিণ্ডিকেট প্রস্তাব পাস করেছে, সরকার যে হাইকোর্ট জজ দিয়ে স্ক্রিনিং কমিটি করেছে তার কাছেই তাঁরা রিপোর্ট পেশ করবেন। আপনারা সরকারি কর্মচারীদের স্ক্রিনিং চান, শিক্ষকদের স্ক্রিনিং চান, বেতারের স্ক্রিনিং চান। অনুগ্রহ করে একটু নিজেদেরও স্ক্রিনিং করুন। একটু বলুন এই লোকগুলো এই কাজ করেছে। আমরা তা মেনে নেবো। আর যদি নিজেরা কিছু না করেন, আমাকে বলবেন। আমি করবো। আমাকে করতেই হবে। কারণ, পাকিস্তানের নামে পয়সা নিয়ে এসে যদি কেউ রাতারাতি খবরের কাগজ বের করে আর মানুষের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে আমাদের সব নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করবার চেষ্টা করে, এখানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়াবার চেষ্টা করে, জাতির আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে সেটাকে স্বাধীনতা বলা যায় না। সে স্বাধীনতা
কোনো সরকার, কোনো জনগণ, কোনো প্রগতিশীল দল কোনোদিন সমর্থন করতে পারে না।
ধর্মঘট
আপনারা যেসব দাবি করেছেন সেগুলি ন্যায্য। সেগুলির জন্য আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। আমরা যতদূর সম্ভব দাবিগুলি পূরণের চেষ্টা করছি।
আপনারা বলছেন, ধর্মঘট বন্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আমি তো ধর্মঘট বন্ধ করি নাই। তবে সমাজতন্ত্রের একটা নীতি আছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শ্রমিকদের কর্তব্য কী সেটাও বুঝতে হবে। এবং শ্রমিকরাই সমাজতন্ত্র চায় বেশি। কিন্তু যখন সরকারের আয় নাই, তখন ২৫ টাকা পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির পরও যদি এটা-ওটা নিয়ে ঘেরাও বা জোরজবরদস্তি চলে, তাহলে কী হয়? এটা কোন ধরনের সমাজতন্ত্র?
আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন যারা সত্যিকার শ্রমিক, তারা এসব করছে না। কিছু কিছু লোক করছে এবং তাদের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করার জন্যই ধর্মঘট বন্ধ করা হয়েছে। তাও মাত্র ছ’মাসের জন্য। আপনারা বিশ্বাস করুন— কারো অধিকার কেউ নষ্ট করুক, এ আমি কখনো চাই না। আমি জীবনভর আন্দোলন করেছি। এবং আন্দোলনের ভিতর দিয়েই আমি এতদূরে এগিয়ে এসেছি। সেজন্য আমি কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করতে চাই না। এ সরকারও কারো ব্যক্তিগত অধিকার নষ্ট করতে চায় না। যেখানে কাজ জানা লোক নাই, ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা নাই, সমাজতন্ত্রের জ্ঞান নাই, সেখানে ব্যাংক এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ সমস্ত মূল শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে যদি কেউ পয়সার জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে, তবে সেখানে আমি বাধা না দিয়ে কী করতে পারি? আমি কি বলতে পারি যে, সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি মুষ্টিমেয় লোক ভোগ করুক?
শহিদদের পরিবারের জন্যে সাহায্য
যারা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারবর্গকে সাধ্যমতো সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া চাঁদা তুলে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল গঠন করে শহিদদের প্রত্যেক পরিবারকে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।
শহিদ সরকারি কর্মচারীদের পরিবার-পরিজনকে পেনশন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং মালিকহীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি তাঁদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে, যাতে তাঁরাও জীবনভর একটা কিছু করে খেতে পারেন। তাঁরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করে পঙ্গু হয়েছেন। যারা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকেও এ সবের একটা অংশ দেওয়ার জন্য একটা বোর্ড গঠন করা হচ্ছে। কেউ বাদ পড়বেন না। সবাই। সেখান থেকে কিছুটা সাহায্য-সহানুভূতি পাবেন।
সাংবাদিকদের কাছে দাবি
আপনাদের দাবি-দাওয়ার উত্তরে আমিও কিছু দাবি জানাচ্ছি। আমি চাই, আপনারাও স্ক্রিনিং করুন। যারা ন’মাস এখানে ছিল, তাদের কারো কারো সম্পর্কে দলিলপত্র আমাদের হাতে ধরা পড়েছে। তাদের গায়ে যদি আমি হাত দেই, আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি সরকারি কর্মচারীকে জেল দিয়েছি, হাইকোর্টের জজকে জেল দিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে জেলে দিয়েছি, এ দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের এবং আওয়ামী লীগের এমসিএ’কেও জেলে দিয়েছি। আপনাদের মধ্যে যাদের অপরাধী পাবো, তাদের নিশ্চয়ই ধরতে হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী বাড়াবাড়ি করলেও আপনারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে, দালাল আইনে— হাকিম আছে, কোর্ট আছে, বিচার হচ্ছে। সরকার যদি আসামির বিরুদ্ধে দলিলপত্র দাখিল করতে না পারে, তা হলে সে খালাস হয়ে যাবে।
সরকারের সমালোচনা
স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, তা রক্ষা করা তার চেয়েও কষ্টকর। স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে বহু সময়ের প্রয়োজন হয় । তবু বিপ্লবের পরে ছ’মাসের মধ্যে আপনারা যতখানি স্বাধীনতা পেয়েছেন, ততখানি স্বাধীনতা এদেশে এর পূর্বে কেউ পায় নাই। কিন্তু অনেকেই তার সুযোগ নিয়ে দুষ্কর্মে মেতে উঠেছে। তার জন্যে আমাকে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। যেমন কারফিউ দিয়ে তল্লাশি চালানো। এতে কিছু সৎ লোকের অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু এই অসুবিধা এড়ানোর উপায় নাই। আর অসৎ লোকের তো আমি আগেই সতর্ক হওয়ার সময় দিয়েছিলাম। কোনো কোনো কাগজে সমালোচনা করে বলা হয়, এখনকার অবস্থা
আইয়ুব-ইয়াহিয়া সরকারের আমলের চেয়েও খারাপ। ১৯৫৮ সালে যখন মার্শাল ল’ জারি হয়েছিল এবং আমাকে বন্দী করা হয়েছিল, তখন এরা কিছুই লেখে নাই। আবার এরাই এখন লেখেন— ‘চালের মণ একশো’ বিশ টাকা ।’ চাল থাকতেও আমি দিচ্ছি না। কিন্তু আমি তো তা বলি নাই । আমি শুধু চেষ্টা করছি। এবং কিছু কিছু দিচ্ছি। চালের দাম মিথ্যা করে বাড়িয়ে বলার অর্থ অন্য জায়গায় আতঙ্ক সৃষ্টি করা। এসব কথা যারা লেখে, তারা মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতি করে। এর নাম সাংবাদিকের স্বাধীনতা?
সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও আপনারা লেখেন। আপনারা জানেন যে, সরকারি কর্মচারীদের জবাব দেওয়ার অধিকার নাই। যদি কেউ কারো নাম করে কিছু লেখেন এবং সে যদি কোনো প্রতিবাদ করে তাহলে সেটা প্রকাশ করাও সাংবাদিকদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অনেক সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধেই তো মিথ্যা কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু কারও প্রতিবাদই খবরের কাগজে ছাপা হয়নি। এটা সাংবাদিকতার কোন নীতিমালায় আছে?
ভীতি প্রদর্শন (ব্ল্যাক মেলিং)
আমি আরও একটা প্রবণতা লক্ষ্য করছি। এটা বাংলাদেশে আগে ছিল না। আমি এটা দেখেছি করাচিতে আর দেখেছি পিণ্ডিতে। এটা হলো ভীতি প্রদর্শন। কোনো সাপ্তাহিক বা সান্ধ্য দৈনিকে কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখে তাকে বলা হতো, টাকা দাও, নইলে আবার তোমার বিরুদ্ধে লেখা হবে। তখন সত্যি সত্যিই টাকা দিয়ে সে কাগজের মুখ বন্ধ করা হতো। আমি লক্ষ্য করছি, এখানেও এই ধরনের একটা প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আরও দেখা যাচ্ছে, যার আয়ের কোনো প্রকাশ্য উৎস নাই, সেও দৈনিক কাগজ বের করছে। রাতারাতি কাগজটা বের হয় কোত্থেকে? পয়সা দেয় কে? আমি শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করেছি, ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত করেছি। এর জন্য তাঁরা কেঁদে মরে৷ তাঁদের পয়সা আসে কোত্থেকে? আমি যদি খবর পাই যে, বিদেশিরা তাদের সাহায্য করছে এবং তখন যদি আমি তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি তাহলেও কি আপনারা বলবেন, সংবাদপত্রের ও সাংবাদিকদের উপর অন্যায় হামলা করা হয়েছে?
আপনারা জানেন, আমি ঢাকা শহরে সাইকেল নিয়ে ঘুরে রাজনীতি করেছি। কিন্তু এখন কিছু কিছু লোক রাতে হাইজ্যাকের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর দিনের বেলায় বিপ্লব করে। তারা দুষ্কৃতকারী। তাদের আয়ের কোনো প্রকাশ্য উৎস নাই। অথচ প্রচুর টাকা খরচ করে। এ টাকা আসে কোথেকে? কে দেয়? আমি যদি এসবের তদন্ত করি, তবে আপনারা নিশ্চয়ই আমাকে দোষ দেবেন না, আশা করি। এটাও আইন।
আদর্শের রূপায়ণ
আমি জানি, আমার মতো আপনারাও চারটি আদর্শ সমর্থন করেন। এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা দেশকে বাঁচাতে চাই। আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাই। আমরা নতুন প্রচেষ্টা নিয়েছি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা দিচ্ছি। দুনিয়ায় দেখা গেছে, সমাজতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে অনেক সময় মানুষের মঙ্গলের খাতিরে বাধা দূর করবার জন্য রূঢ় হতে হয়েছে। সেটা আমি করতে চাই না। এ জন্য যে, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি’। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কি-না, আমি চেষ্টা করে দেখছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমার আন্দোলন। সেই জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব নষ্ট হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও আমাদের আদর্শ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নাই। রাজাকার, আলবদররা এখন কিছু কিছু বড় বড় প্রগতিশীল নেতার আশ্রয় নিয়ে প্রগতিশীল’ বনে গেছে। আসলে তারা খুনের মামলার আসামি। তাদের নামে হুলিয়া রয়েছে। এখন তাদের কেউ বলে, আমি অমুক নেতার সেক্রেটারি; কেউ বলে, আমি সম্পাদক। এক্ষেত্রে আমার কর্তব্য কী— আপনারাই বলুন।
সাংবাদিকের স্বার্থ
আপনারা সাংবাদিক। আপনাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে আপনারা নিজেরাও আত্মসমালোচনা করুন। আপনারা শিক্ষিত। আপনারা লেখক, আপনারা ভালো মানুষ। আপনারাই বলুন, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ? আমরা নিশ্চয়ই আপনাদের সাথে সহযোগিতা করবো।
আপনাদের দাবি-দাওয়ার কথা আমি আগেই বলেছি। আপনারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। আমি বড় খুশি হয়েছি। আমি সারা জীবন আপনাদের সঙ্গে সংগ্রামে ছিলাম। এখনও আমি সংগ্রামে আপনাদের সঙ্গে আছি। আপনাদের ন্যায্য পাওনা যা আছে তা নিশ্চয়ই আপনারা পাবেন। কিন্তু তার বেশি চাইলে দেওয়া সম্ভব নয়। আমি পারব না। বাংলাদেশের মানুষকে আমি বলেছি– তিন বছর কিছুই দিতে পারব না। তারা তা মেনে নিয়েছে। আশা করি, আমার সাংবাদিক ভায়েরাও বলবেন- তিন বছর কিছুই চাই না। কারণ, আপনারা কোনো পৃথক জাত নন। আপনারা সাত কোটি লোকের একটা অংশ। তাছাড়া, গণতন্ত্রের একটা নীতিমালা আছে। সাংবাদিকতারও একটা নীতিমালা আছে। এ দু’টো মনে রাখলে আমরা অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবো।
জয় বাংলা।
সূত্রঃ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ– শেখ হাসিনা