১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এই বাংলার মাটিতে জন্ম নিলো এক দেবশিশু। বাবা-মা আদর করে নাম দিলেন খোকা। টুঙ্গিপাড়ার ধুলো-মাটি মেখে বেড়ে ক্রমেই উঠলো সে। মধুমতি-বাইগার নদীর পানি ছুঁয়ে আসা বাতাসের পরতে পরতে সুজলা-সুফলা ঘ্রাণ, আর ভোরের কুসুমসূয্যের কিরণে ক্রমেই মহীরূহ হয়ে উঠলো ছোট্ট খোকা। তাল-তমাল-হিজলের সবুজ সমারোহে সেই হৃদয় প্রশস্ত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকলো। দেখতে দেখতে দ্রুতই স্মৃতি হয়ে গেলো নদীর পানিতে ঝাপাঝাপি আর বর্ষার বৃষ্টিতে ভেজার চঞ্চল দিনগুলো। বাইগার নদী যেমন এঁকে বেঁকে মধুমতিতে চলে যায়, তেমনি টুঙ্গিপাড়া থেকে শুরু করে সারা দেশের প্রতিটি আনাচা-কানাচে ঘুরে, খোকার বাড়ি হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। আর খোকা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।
আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিকে স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দেন এই ভূমিপুত্র। ছোট্ট খোকা থেকে হয়ে ওঠেন জাতির পিতা। এরপর বিশ্বনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কোনো ব্যক্তির নাম নয়, বাংলাদেশের প্রতিধ্বনি।
দীর্ঘ দুই যুগের সংগ্রামের পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই পুরো সংগ্রাম, মুক্তির আন্দোলন এবং স্বাধীনতার সবকিছু ঘটেছে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে। অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে ব্রিটেনের অন্যতম পত্রিকা নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে অভিহিত করে। বিশ্ব এর আগে কখনো এমন নেতা দেখেনি। তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে ব্রিটেনের আরেক শীর্ষ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে বলা হয়‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’।
শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই সমীহ করতেন শেখ মুজিবকে। আফ্রিকার অনেক দেশের মুক্তি সংগ্রামেও মুজিব নামটি অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ভিয়েতনামের ঐতিহাসিক যুদ্ধেও যোদ্ধারা দীর্ঘ-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জীবন জেনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিশ্বমঞ্চে যখন আবির্ভাব ঘটলো বঙ্গবন্ধুর, তখন বিশ্বনেতারা তাকে একবার কাছে থেকে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। এরকমই একটি সময়ে, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’ সদ্যস্বাধীন একটা দেশের প্রধান থেকে শেখ মুজির রহমান হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রধানরা তাকে মানবতা ও মুক্তির দূত হিসেবে গণ্য করতেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে কুচক্রীরা। এই খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্বসম্প্রদায়।
বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের খবর প্রকাশ হওয়ার পর কেঁপে ওঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। মুজিবহীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেও পারছিল না কেউ, তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুকে দিয়েই তারা বাংলাদেশকে চিনেছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’ দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনি জনগণের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমিই রাষ্ট্র।’
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনির কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজি এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’
বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনেছে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে
আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক ও মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী নেতা মাহাথির মোহাম্মদ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার কারণেই বাংলাদেশ এতিম হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলও বাংলাদেশকে চিনতো বঙ্গবন্ধুর নামে। বাঙালির জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুকে খুনের ঘটনায় বিশ্ববাসী এই জাতি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘আফ্রিকার কোটি কোটি কৃষ্ণ মানবের মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলার সমক্ষ তোমাদের নেতা (বঙ্গবন্ধু)। তার অবর্তমানে বাংলাদেশ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে এবং এতিমের মতো অবহেলা ও অবজ্ঞার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। জন্মের পরপরই বাংলাদেশ অভিভাবকহীন ও নেতৃত্বহারা হয়ে পড়ায় এই দেশটির যে বিশাল সম্ভাবনা ছিল, তা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তোমাদের জাতির ভাগ্যে এতোবড় ট্রাজেডি দেখে খুব আফসোস হয়।’
বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকপটে মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘তিনি তার দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, অন্য দেশের কারাগারে থেকে, শুধু তার নামের জাদুমন্ত্রে পৃথিবীর ভৌগলিক রেখা পরিবর্তন করে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটান। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির নেই।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রসঙ্গে মাহাথির আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সেদিন মালয়েশিয়ার মসজিদেও তার জন্য দোয়া করা হয়। ইসলামের মহান খলিফাদের সঙ্গে যেনো শেখ মুজিবের বেহেশত নসীব করার জন্য দোয়া করেন ইমাম সাহেব। সেদিন শুক্রবার ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মসজিদেও বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করা হয়েছে।’
‘‘নেপোলিয়ন যা পারেনি, শেখ মুজিব তা করে দেখিয়েছেন’’
বিশ্বজুড়ে নন্দিত ফ্রান্সের নেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তাকে নেপোলিয়ন দ্য গ্রেট বলা হয়। সেই নেপোলিয়নের চাইতেও বঙ্গবন্ধুকে সফল বলে মন্তব্য করেছেন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রানচিস মিতেরা। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদকে সরাসরি তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের দেশের অদৃশ্য শক্তিধর এই লোকটির কী অজানা জাদু ছিল! দেখো, আমাদের ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট দি গ্রেট। তিনি ফ্রান্স থেকে বহু দূরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি হয়ে পড়েন, তোমাদের শেখ মুজিবের মতো বন্দি হওয়ার পর আমাদের জাতীয় বীর ফরাসি জাতির জন্য বা ফ্রান্সের জন্য আর কোনো অবদান রাখতে পারেননি। কিন্তু তোমাদের ভাগ্য-নির্মাতা (বঙ্গবন্ধু) তোমাদের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, অন্য দেশের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ডেথ সেলে বসেও, শুধু তার নামের অজ্ঞাত জ্যোতির্ময় আলোকচ্ছটা নিক্ষেপ করে, পৃথিবীর ভৌগোলিক রেখা পরিবর্তন করে, একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটান এবং একটি নতুন জাতির জন্ম দেন।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে এক বিস্ময়কর ঘটনা বলে অভিহিত করে ফ্রান্সের এই রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, ‘সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এবং বিশ্বের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে এমন দ্বিতীয় কোনো বিস্ময়কর ঘটনা কেউ কোনদিন, কোথাও প্রত্যক্ষ করেনি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো যোদ্ধা জাতিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অখ্যাত-অজ্ঞাত বীরযোদ্ধারা যখন পরাজিত করেছে বলে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে ভূমিকম্প তৈরি হয়। বিশ্বের নেতারা এবং সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা বিশ্বাস করতে পারছিলো না! যার শিহরণ জাগানো জাদুবলে প্রায় শূন্য সামরিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তোমরা (বাঙালি জাতি) ঐতিহাসিকভাবে বিজয়ী জাতির খেতাব পেলে, তার নামের গৌরব-গাঁথা বিশ্বের সব মানুষের হৃদয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে তোলো না কেন?’
১৯৯০ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রানচিস মিতেরা যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেন, তখন প্রবেশমুখে একনায়ক এরশাদ বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখিয়ে তাকে বলেন, ‘একসিলেন্সি, ইনি আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।’ এরপর সেই ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। এরপর তিনি এরশাদকে বললেন, ”তোমরা শেখ মুজিবকে ‘মুজিব দ্য গ্রেট’ অর্থাৎ মহান বীর শেখ মুজিব বলে সম্বোধন করো না কেন? নেপোলিয়ান বোনাপার্টকে ‘দ্য গ্রেট’ অর্থাৎ ফ্রান্সের মহান জাতীয় বীর বলে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে আমরা সম্বোধন করি, ইউরোপের অন্যান্য জাতি তাদের জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ বীরের নামের শেষে ‘দ্য গ্রেট’ অর্থাৎ মহান জাতীয় বীর বলে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে।’
এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক মুসা সাদিক। তিনি তার ‘বিশ্বনেতাদের চোখে বঙ্গবন্ধু’ বইতে এই তথ্য বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। আড়গড়গাই হাজার বছরে যা কেউ পারেনি, সেই স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু যে ছক এঁকেছিলেন, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা মারফত আগাম তথ্য জানার কথা জানিয়েছেন কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা তিনি। সেসময় বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান নেতা হিসেবে প্রভাববিস্তার করেছিলেন তিনি।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সফরকালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতার কথা জানান পিয়েরে ট্রুডো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে ১৯৭০ এর দশকেই বাঙালি জাতিকে নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে লিপ্ত হবেন, আশির দশক পর্যণ্ত অপেক্ষা করবেন না, এমন গোয়েন্দা তথ্য উপ-রাষ্ট্রদূত অফিসের গোয়েন্দা মারফত আমরা পেয়েছিলাম। সেটার ব্যাখ্যা সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা তা সংগ্রহ করতে পারিনি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করা সেই ব্যাখ্যায় আমরা জানতে পারি যে, আশির দশকের পর রাশিয়ার রেড আর্মি থাকবে না বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। তখন পৃথিবীর ভারসাম্য একদিকে (যুক্তরাষ্ট্রের দিকে) হেলে পড়বে, আর তারা পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি ১৯৭০ সালেই যুদ্ধ শুরু পরিকল্পনা করেছিলেন। তার সেই পূর্বাভাস ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বিশ্বের বড় বড় নেতারা বিস্মিত হয়ে পড়েন। তাই তারা ১৯৭২ সালে তার কাছে তার দৈবদৃষ্টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।’
‘যাদের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে, বঙ্গবন্ধু তাদের চেয়েও বড় নেতা’
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের চেয়েও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বড় নেতা বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। সশ্রদ্ধ চিত্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বাংলাদেশি সাংবাদিক মুসা সাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রথম সারির নেতা ছিলেন এবং যাদের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তাদের সবার চেয়ে শেখ মুজিব অনেক বড় নেতা ছিলেন। ভারতের নেতাজি সুভাষ বসু, যিনি বাংলাদেশের মতো মুক্তিযুদ্ধ করে ভারতের আজাদি ছিনিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, একমাত্র তার সঙ্গে তোমাদের নেতার (বঙ্গবন্ধুর) তুলনা হতে পারে।’
১৯৯৬ সালের ২৫ মে, ভারতে বসে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। বাংলাদেশি সাংবাদিককে তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিও যে- আমি বলেছি, তোমাদের শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বের বহু নেতার চেয়ে অনেক বড় নেতা। তিনি পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চেয়েও অনেক বড় নেতা। এমনকি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রথম সারির নেতা ছিলেন এবং যাদের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তাদের সবার চেয়ে শেখ মুজিব অনেক বড় নেতা ছিলেন।’ উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রস্তাবটি অটল বিহারী বাজপেয়ীই প্রথম উত্থাপন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তুমি কী হে ছেলে, ইতিহাস পড়োনি? তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তুমি তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছ, কিন্তু কে তোমাকে মুক্তিযুদ্ধ দেখিয়েছে? কে তোমাকে মুক্তিযোদ্ধা করেছে? তোমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা কোনো মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমাদের নেতারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হতে দেয়নি। আমাদের নেতারা সমঝোতা করে, সব অধিকার ও দাবি- দাওয়া ছেড়ে দিয়ে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে, ভারতের স্বাধীনতা উপহার হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু তোমাদের বীর বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করে তোমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। আফ্রো-এশিয়ার দেশে দেশে, পাহাড়ে- জঙ্গলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য যারা আজও লড়ছে, তারা তার (বঙ্গবন্ধুর) নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। তার নামের ধ্বনি দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা লাভ করছে। এই একটি ঐতিহাসিক কারণে তোমাদের জাতির পিতা পাকিস্তান ও ভারতের শীর্ষ সব নেতাকে অতিক্রম করে গেছেন। সত্য খুবই নির্মম, সেই নির্মম সত্য আমি উচ্চারণ করলাম। আমার যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। কত দিন বেঁচে থাকব জানি না।’
অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারতীয় রাজনীতির প্রবাদপুরুষদের একজন বলে গণ্য করা হয়। তিনি যখন তরুণ, তখনই তার বক্তব্য শুনে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘বাজপেয়ী একদিন প্রধানমন্ত্রী হবে।’ সেই বাণী সত্য হয়েছিল। দল-মত নির্বিশেষে ভারতের রাজনীতিতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে সন্মানিত হয়েছেন বাজপেয়ী। ভারতবর্ষের বিভাজন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন তিনি। এমন একজন মহীরূহ ব্যক্তিত্ব নিজের জীবন সায়াহ্নে এসে অকপটে নির্মম সত্যের স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছেন। এক জীবনে দেখা নেতাদের মধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুকেই শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো তীব্র জাতীয়তাবাদী নেতা বিশ্বের ইতিহাসে আর নেই, যিনি কিনা একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এমনকি একটা জাতিকে গোলামি থেকে মুক্ত করার পর গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
বিশ্বনেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন একজন জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্ব
১৯৭১ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন উইলি ব্রান্ডিট। ১৯৭৭ সালে পশ্চিম জার্মানিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাংলাদেশের ভূখণ্ড সম্পর্কে আগে তার ধারণা ছিল না। কিন্তু ডেথ সেলে বন্দি অবস্থায় তিনি যে ম্যাজিক পাওয়ার প্রদর্শন করে একটা জাতিকে স্বাধীন করেছেন, সেটা বিশ্বনেতাদের কাছে অলৌকিক ঘটনার মতো ছিল। বিশ্বনেতারা তাকে এক পলক দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল।
এরপর ক্ষোভ প্রকাশ করে উইলি ব্রান্ডিট আরো বলেন, ‘এমন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন বিশ্বনেতাকে তোমরা হত্যা করলে কেন? যাকে ছাড়া বিশ্বনেতারা তোমাদের স্বীকৃতি দিতো না। তার হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববাসী তোমাদের জাতিকে আর বিশ্বাস করে না।’
বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো বিশ্ব
আচমকা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শুনে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। এই দুঃসংবাদ শোনার পর, বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের প্রতীকে পরিণত হওয়া কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’ ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন সেদিন শোক দিবস পালন করেন। এমনকি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে জি মোস্তফাকে সেদিনই ইরাক থেকে বের করে দেন। সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’
পরবর্তীতে কে জি মোস্তফা ঢাকা প্রেসক্লাবে সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে বলেছেন, ‘সকালে (১৫ আগস্ট) সাদ্দাম হোসেন তার বিশেষ ফোর্স দিয়ে আমাকে প্রাসাদে তুলে নিয়ে যান, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য আমার কাছে কৈফিয়ত চান। ক্ষুব্ধ আচরণ করেন। বাকিতে দেওয়া ইরাকি তেলের সব টাকা সাত দিনের মধ্যে পরিশোধের হুকুম দেন। এরপর আমাকে তার দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। সিরিয়াগামী একটি ফ্লাইটে জোর করে তুলে দেওয়া হয় আমাকে।’
কান পাতলে আজো শুনতে পাই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারেনি বাঙালি জাতি। স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রীরা এই দেশকে আবারো শ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছিল। দুই দশকের এক দীর্ঘ বিভীষিকাময় সময় ছিল সেটা জাতির জন্য। অথচ, বহির্বিশ্বে কিন্তু তখনও বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হতো। জাতি হিসেবে আমরা কতোটা দুর্ভাগা যে, সুদূর ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রনায়করা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নাম শুনলে শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করে, কিন্তু আমরাই আমাদের জাতির পিতার ইতিহাস বিকৃত করেছি। এই কুকর্মের জন্য বিদেশ-বিভূঁইয়েও বাঙালি জাতিকে অনেকবার ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে নিজের মুগ্ধতার কথা অকপটে বলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের তিন দশক পর, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি কমপ্লেক্সে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেনেডি বলেন, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। খুব পপুলার স্লোগান। আমি যেন কান পাতলে আজও শুনতে পাই। মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রণাঙ্গণ পরিদর্শনে এসেছিলেন ম্যাসাচুসেটস-এর এই সিনেটর। সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখার সময় এই স্লোগান শোনেন তিনি। সেসময় আমেরিকার সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও, মার্কিন জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন দেশটির বিরোধীদলীয় ডেমোক্রেটিক পার্টির এই নেতা। কারণ হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি মুগ্ধতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের দেশে তোমাদের নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চলছিল, যেটা শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। কিন্তু সেটা কমিউনিস্টদের যুদ্ধ ছিল না। সে কারণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আমেরিকান জাতি তোমাদের শতভাগ সমর্থন দেয়। আমার জাতির পক্ষে সেই সময়ে তোমাদের রণাঙ্গনে গিয়ে আমি সেটা ব্যক্ত করেছিলাম। সেখান থেকে আমেরিকায় ফিরে এসে, আমাদের সিনেটে তোমাদের পক্ষে একের পর এক প্রস্তাব পাস করিয়েছিলাম। যার ফলে পাকিস্তান ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়ে।’
পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তার ধানমন্ডির বাসায় এসেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যাপারে কেনেডি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বশান্তির দূত। বিশ্বশান্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু পাকিস্তানে বহু বছর ধরে সামরিক শাসন চলছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসন এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ক্যান্সার। তিনি আমাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় আমি এবং আমার দল ডেমোক্রেটিক পার্টি যেন ভূমিকা রাখি। তাহলে এশিয়ায় শান্তি বজায় থাকবে। এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে এবং পারস্পরিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। তার (বঙ্গবন্ধুর) ধ্যান-জ্ঞান ছিল বাংলাদেশ ও বিশ্বশান্তি এবং তিনি ছিলেন যুদ্ধবিরোধী ও বর্ণবাদবিরোধী; যার সঙ্গে আমার আদর্শের মিল ছিল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তির অপচেষ্টা হয়েছে, সে ব্যাপারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি বলেন, ‘রণাঙ্গনে তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের গগনবিদারী স্লোগান শোননি? তাদের কণ্ঠে আমি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শুনেছি, তুমি তা শোননি? তুমি তো নিজেই এসবের সাক্ষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেছে, কে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে, কে দেশটির স্থপতি, বিশ্বের সব নেতা ও ঐতিহাসিকরা তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই বিশ্ববাসী তোমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার নামেই বাঙালিকে স্বাধীন জাতির মর্যাদা দিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতের অপচেষ্টাকারীদের ব্যাপারে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু তোমাকে বলব, পৃথিবীতে দু-শ্রেণির প্রাণী আছে। মনুষ্য প্রাণী ও অমনুষ্য প্রাণী। তোমাদের বাঙালি জাতির ভাগ্য পাল্টাবে কে, যদি তোমাদের মনুষ্য জাতির মধ্যে অমনুষ্য প্রাণীর আধিপত্য প্রবল হয়ে ওঠে। যারা বিশ্বনন্দিত মহামানবসম শেখ মুজিবকে হত্যা করে অহংকার করতে পারে, তারা নরকের কীট।’