শুধু মুখে নয়, বুকেও থাকুক বঙ্গবন্ধু

।। শরিফুল হাসান ।।
বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০২২

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই। যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই! তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।

গানের কথাগু‌লো শুনলেই চোখ ভিজে আসে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা শুধু বাংলায় কেন এই গোটা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই যিনি একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি দিনের পর দিন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য এবং সত্যি সত্যি তিনি সেই দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন!

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১। টানা ২৪ বছরের সেই সংগ্রাম যেন এক মহাকাব্য, যেই কাব্যের ধারাবাহিকতায় কখনো ছয় দফা, কখনো বা সরাসরি ঘোষণা, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বাংলাদেশে যোগ্য নেতা নেই বলে আমরা সবসময় হা হুতাশ করি। উন্নত কোনো রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের সততার সঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন দেখলে আমরা খুশি হই। কেউ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ছাড়া স্বাভাবিকভাবে ঘুরলে তাকে স্বাগত জানাই। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে সবসময় সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়া থাকলে আমরা তাকে জনপ্রিয় নেতা বলি। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান উদার হলে তাকে মহান বলি।

অথচ এই সবকিছুই ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। সারা পৃথিবী খুঁজে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন অসাধারণ নেতা পাওয়া দুষ্কর।

কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কিংবদন্তি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’

ফিলিস্তিন মুক্তি মোর্চার সাবেক নেতা, নোবেল বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, ‘আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব ও কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বিশেষত্ব।’

আমরা বড় অভাগা জাতি এমন বিশ্বনেতাকে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এই দেশেই। যে পাকিস্তানিরাও সাহস করেনি তাকে হত্যা করতে স্বাধীন দেশে সেই বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা হয়েছিল।

পঁচাত্তরের সেই ১৫ আগস্টের শ্রাবণের রাতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের অশ্রু যেন এক হয়েছিল। আসলে তো শুধু তো বঙ্গবন্ধু নন, তার আদর্শকেই হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। তাই তো বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্যরা এমনকি নারী বা শিশু রা‌সেলও বাদ যায়‌নি।

১৫ আগস্টের সেই কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল ও সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।

প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত ও এক আত্মীয় আবদুর নঈম খান রিন্টুকে হত্যা করে।

কলঙ্ক তো এখা‌নেই শেষ নয়! সভ্য দুনিয়ার যে কোনো খুনের বিচার হয়। আর বাংলা‌দেশে সেই খুনি‌দের পুরস্কৃত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ১২ খুনিকে কয়েকটি দেশের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়।

আরও ভয়ঙ্কর হলো খুনিদের যেন বিচার না হয় সেজন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। তাতে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যারাই ক্ষমতায় ছিল সবাই এই কালো আদেশ বহাল রেখেছে। বহাল রেখেছে খুনিদের চাকরিও। আর এই সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে নানা মিথ্যা ছড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে টানা ২১ বছর তো বঙ্গবন্ধুর নামটাও নেওয়া যেত না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর এই মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।

অবশ্য এখনো অন্তত ছয় খুনি বিদেশে পলাতক। তবে শুধু খুনিদের ফাঁসি দিলেই কলঙ্কমোচন হয়ে যায় না, এই হত্যায় দেশে-বিদেশে কারা মদদ দিয়েছিল, কার কী ভূমিকা সেগুলোও তদন্ত করা দরকার।

আসলে ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতীয় শোক দিবস নয়, দিনটা একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বাঙালি অকৃতজ্ঞ জাতি। অথচ ১৫ আগস্ট কালরাতে যদি বঙ্গবন্ধুকে হায়েনারা হত্যা করতে না পারতো, আর মাত্র ১০টা বছর যদি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র চালাতে পারতেন তাহলে হয়তো ভিন্ন এক বাংলাদেশ পেতাম আমরা!

তবে টানা ১২ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চাও বা কতটা হচ্ছে? আজ ১৫ আগস্টে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শোক কতটা মুখে, আর কতটা বুকে?

ফেসবুক কিংবা শহরজুড়ে পোস্টার-ব্যানার, গরু জবাই কিংবা বিরিয়ানি এগুলো খুব সহজে দেখা যায়, দেখানো যায়। এসব দিয়ে শোক প্রকাশ করা যতটা সহজ, বুকের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শব্দটা রাখা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা কাজগুলো সেই তুলনায় একটু কঠিন।

আফসোস, এই দেশে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে আমলা কিংবা নানা পেশাজীবী লোকজন তথা আমরা শোক প্রকাশের জন্য সহজ পথটা বেছে নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চাকারী কম। অথচ এই আদর্শের চর্চা করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা দেখানো হয় না।

প্রশ্ন উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী? আমি তো বলবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে তার দেশ্রপ্রেম, তার অপোসহীনতা, তার সততা, সবসময় মানুষের কথা ভাবা, মানুষের জন্য অসীম ভালোবাসা।

একটা মানুষ দেশকে কী পরিমাণ ভালোবাসলে বলতে পারেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’

ভেবে দেখেন, আওয়ামী লীগ একযুগেরও বেশি সময় ক্ষমতায়। গত ১২ বছরে মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলা লোকের সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চার লোক কতোটা বেড়েছে? এই আলোচনা হওয়া দরকার কারণ মুখে বঙ্গবন্ধু বলার চেয়ে অন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শধারী লোকের সংখ্যা বাড়লে তো এতো দুর্নীতি হতো না, অসততা হতো না। বঙ্গবন্ধু তো এগুলো করেননি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, কালোবাজারি, অর্থপাচার এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘১৯৭১-এ আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম প্রত্যেক ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। আজ ১৯৭৫-এ আমি আহ্বান জানাই প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।’

শুধু কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেই তো দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে সৎভাবে বেঁচে থাকা। বঙ্গবন্ধু আদর্শ মানে সবার কথা ভাবা। ন্যায্য কথা বলা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানলে তো রাজনীতির নামে কেউ ভণ্ডামি করতো না, রাজনীতি করে নিজের আখের গোছাতো না, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতো না।

বঙ্গবন্ধু তো এগুলোর কোনোটাই করেননি। অথচ আজ হরহামেশা সেগুলোই হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে যারা দুর্নীতি করেন, দেশের সর্বনাশ করেন, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন তারা তো আসলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম নেন।

অবশ্য এসব লোক দেখানো ভালোবাসায় কিছু যায় আসে না। কারণ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এদেশের একদল মানুষ বুকের মধ্যে সযত্নে বঙ্গবন্ধুকে লালন করেছেন। আসলে বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার তো আসল মৃত্যু নেই।

আজ শোকের দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুসহ নিহত সবাইকে। আসলে যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন থাকবেন বঙ্গবন্ধু।

আর সে কারণেই বাঙালি কবি ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথাগুলো বলতে হয়-

যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান

ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ