স্বাধীনতার পূর্ণতার দিন

রিপোর্টার
সোমবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২২

আহমেদ রিয়াজ

বাঙালি, বদ্বীপ- বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু। বাঙালির বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে বুঝতে পারল সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতি। নইলে বাংলাদেশে আজও অনেক অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে যেত। কতদিন ধরে এসব সমস্যা জিইয়ে থাকত, তা বলা মুশকিল।

বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয় ২৬ মার্চ রাতে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তাকে নিয়ে কম নাটক করা হয়নি। বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার জন্য একদিকে প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয় পাকিস্তানিরা। অন্যদিকে বাংলার গণমানুষের নেতা, প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও একের পর এক নাটক করতে থাকে তারা। ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গকে একটি সাক্ষাৎকার দেন বঙ্গবন্ধু। ১৮ জানুয়ারি ওই পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘He Tells Full Story of Arrest and Detentio’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে নয় মাসে বন্দিজীবনের কথা বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। বন্দি হওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েক মিনিট সময় পান বঙ্গবন্ধু। তখন পরিবারের সবাইকে ডেকে বলেন-

“ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু জানবে, একদিন আমার মানুষ মুক্ত হবে। আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।”

বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন তিনি হয়ত আর জীবিত ফিরতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে তার কোনো সন্দেহই ছিল না। তার আত্মবিশ্বাস ছিল দেশের মানুষের প্রতি। আত্মবিশ্বাস ছিল তিনি দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে সঠিকভাবে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে মানুষ ঠিকই সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে।

বন্দি করার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় পরিষদ ভবনে। সেখান থেকে সামরিক ছাউনির একটি স্কুলের নোংরা ও অন্ধকার ঘরে ছয়দিন তাকে আটকে রাখে।

এরপর ১ এপ্রিল তাকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। কিছুদিন পর সেখান থেকে সরিয়ে তাকে আনা হয় মিয়ানওয়ালির কারাগারের ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত একটি সেলে। এরপর পাঞ্জাবের উত্তরে লায়ালপুর ও শাহিওয়ালের দুটি কারাগারে তাকে স্থানান্তর করা হয়। আর এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে শুরু হয় বিচার। ছয়টি অভিযোগের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা।’

সামরিক আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো বিচার শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগও তাকে দেয়া হয়নি। বিচার শেষ হতেই রাওয়ালপিন্ডি থেকে সেনাকর্তাদের ডেকে শেখ মুজিবকে গুলি করে হত্যা করার জন্য দ্রুত প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশও দিয়েছিল ইয়াহিয়া খান। তবে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় নির্দেশ কার্যকর হলো না। এরপর ৭ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালিতে ফিরিয়ে আনা হলো বঙ্গবন্ধুকে। তাকে গুলি করে হত্যার চূড়ান্ত তারিখ ঠিক করা হলো ১৫ ডিসেম্বর ভোর ছয়টা। জেলখানার কর্তাদের জানানো হয় পূর্ব পাকিস্তানে নিয়াজিকে হত্যা করেছে বাঙালিরা।

কাজেই প্রতিশোধ হিসেবে মুজিবকে হত্যা করা হবে। পাকিস্তানি সেনাকর্তা ও জেলকর্তারা তাতে সম্মতিও জানিয়েছিল। এমনকি সেলের বাইরে তার কবর খুঁড়েও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাকে হত্যা করার দুই ঘণ্টা আগে জেলসুপার সেলের দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে বের করে নিয়ে আসতে চান। তখনও বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতই ছিলেন, তাকে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাকে নামাজ পড়ার জন্যও সময় দেয়া হয়নি। চটপট সেল থেকে তাকে বের করে অজ্ঞাত এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে নয়দিন রাখা হয়।

এরমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে গেছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হন ১৯ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কথা বলতে চান।

এবার বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে রাষ্ট্রপতিভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ২৪ ডিসেম্বর তার সঙ্গে দেখা করতে আসে নাটের গুরু ভুট্টো। তবে ভুট্টো তখন বাস্তব অবস্থা বুঝতে পেরেছিল। যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণকারী ও বন্দি প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্য কেউ জীবিত থাকবে না।

কারণ বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালির মুক্তির মহান নেতাই নন, বাঙালির আবেগের সর্বোচ্চ স্থানে তার অবস্থান। আর পাকিস্তান তাদের এক লাখ সৈন্য হারানোর অর্থই হলো ভুট্টোর ক্ষমতার চেয়ার নড়বড়ে শুধু নয়, পাকিস্তানিদের কাছে নায়কের পরিবর্তে ভুট্টো হয়ে যাবে খলনায়ক। পশ্চিম পাকিস্তানেও দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান তো গেছেই, এই দাঙ্গায় অখণ্ডতা হারাতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানও। তখন কেবল সদ্য পাওয়া ক্ষমতার গদি নয়, নিজের পিঠের চামড়া বাঁচানোও ভুট্টোর জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পরামর্শে তাই মুজিবকে হত্যা করার ঝুঁকি নিল না ভুট্টো। বরং পাকিস্তানের দুটো প্রদেশের মধ্যে কোনো রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। বেহায়া ভুট্টোর দাবি, আইনের চোখে পাকিস্তানের দুই অংশ একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। বঙ্গবন্ধু জবাবে বললেন, ‘পাকিস্তান যদি এখনও অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নন, আমি।’

ভুট্টো ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে গৃহবন্দি রেখে দাবি আদায় করে নেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়সম উচ্চতার নেতাকে ভুট্টোর মতো চামচিকে নেতার পক্ষে টলানো কখনোই সম্ভব ছিল না। তবু ৭ জানুয়ারি শেষ চেষ্টা করলেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘হয় আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন।’

টলায়মান ভুট্টো শেষপর্যন্ত মুক্তি দিলেন বঙ্গবন্ধুকে। মুক্তি পেয়ে লন্ডনে এসে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা পান বঙ্গবন্ধু। লন্ডনের বাইরে থাকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ পর্যন্ত পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে ছুটে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। এরপর দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে ঢাকা আসেন বাঙালি জাতির পিতা। তার আগমনের অপেক্ষায় সেদিন লাখ লাখ মানুষ রাস্তার দুপাশে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর করে রেখেছিল।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কতটা জরুরি ছিল, তার কিছুটা নজির কিন্তু লন্ডনেই দেখা মিলেছে। একটা জাতি বা দেশ কেবল স্বাধীন হলেই পূর্ণতা পায় না। স্বাধীনতাও রক্ষা হয় না। কারণ স্বাধীনতা অর্জন করা যতটা সহজ, সেটা রক্ষা করা তার চেয়ে কঠিন কাজ। বঙ্গবন্ধু ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা মোটেই সহজ ছিল না। অনেকগুলো জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয় একটি সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বেঁচে থাকা মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয় তো আছেই। সঙ্গে আছে আহতদের চিকিৎসা ও পঙ্গুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তার ওপর সম্ভ্রম হারানোর প্রায় দুই লাখ নারীর সামাজিক মর্যাদার বিষয়টাও জরুরি ছিল। সম্ভ্রব হারানো মা-বোনদের চিকিৎসা ও অন্যান্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। টানা নয় মাস পাকিস্তানিদের অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে নষ্ট হয়েছিল দেশের সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক ভারসাম্য। শুধু ব্যক্তিত্ববানই নয়, দেশের সব মানুষের ভালোবাসা পাওয়া কোনো জাতীয় নেতা ছাড়া এতসব ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা মোটেই সম্ভব ছিল না। এর বাইরে রয়েছে স্বাধীন দেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বময় নেতার পক্ষে সে সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায় যতটা সহজ, সেটা তো আর কারো পক্ষে অতোটা সহজ ছিল না কিংবা অসম্ভবই ছিল বলতে গেলে। আর সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, সেটা হচ্ছে ভারতীয় সৈন্য। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টা তারচেয়েও অনেক বেশি জরুরি। একবার ঢুকতে পারলে মিত্রশক্তি সহজে কোনো দেশ থেকে সরতে চায় না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার ৭৭ বছর পরও এখনও জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে মাত্র তিন মাসের মধ্যে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক কৌশলে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আনাটাও সহজ কাজ নয়। দেশ পুনর্গঠনের বিষয় তো আছেই। আর এতসব বোঝা বহন করে সব সমস্যার সমাধান করা বঙ্গবন্ধু ছাড়া কি সম্ভব ছিল? কখনোই সম্ভব ছিল না। সম্ভব যে ছিল না, সেটারও প্রমাণ হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর।

সব মিলিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্পই ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশ যে চিন্তাই করা যায় না। তাঁকে পেয়ে বাঙালির স্বাধীনতা, বাঙালির বিজয় পূর্ণতা পেয়েছিল। আর সে কারণেই ১০ জানুয়ারি কেবল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসই নয়, বাঙালির স্বাধীনতার পূর্ণতার দিনও।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ