আজ ২১ মে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির জন্মদিন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে ছোট বোন শেখ রেহানার এই ছেলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘ববি সিআরআইয়ে পরিচালক হিসেবে কাজ করে। ইউএনডিপিতেও কাজ করে। সরকারের অনেক উদ্ভাবনী আইডিয়াতে সে কাজ করছে। সে নীরবে কাজ করে।’ ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে। এর আগে অবশ্য ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পে দুই বছর মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইবার প্রচার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ববি ওই প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। তখন জাতীয় নির্বাচনে অনলাইন প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর অনলাইনভিত্তিক প্রচার বা সাইবার স্পেসের মূল দায়িত্বে ছিলেন ববি। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ দখল ও নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল হিসেবে ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কাজ নিয়ে ‘আপনি জানেন কি’ শিরোনামে ১৭টি প্রামাণ্যচিত্র এবং অন্যান্য সরকারের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের তুলনামূলক ১৯টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি এবং নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুষ্ঠান ‘ইয়াংবাংলা’র পেছনের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ববি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একইভাবে আওয়ামী লীগের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ সকল রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ফলে প্রচার-প্রচারণা করে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচনে জয়ী করার কৌশল গ্রহণ করতে হয় শেখ হাসিনার দলকে। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ অনলাইন মিডিয়া ব্যবহার করে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে নৌকা প্রতীক পৌঁছে দিতে সক্ষম হন সে সময়। এ জন্য ভারতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ লিখেছিল- ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন ইন্দিরা গান্ধীর দৌহিত্ররা তেমনি ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ববি ও জয়।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এক্ষেত্রে ‘ইয়াংবাংলা’, ‘জয়বাংলা কনসার্ট’ এবং ‘মুজিব’ সিরিজের কাজের কথা প্রথমেই মনে আসবে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আইকন। তিনি আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি। সিআরআইয়ের হেড অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড প্রোগ্রাম হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা ববি।
তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরামর্শে পরিচালিত ‘সিআরআই’ ও ‘ইয়াংবাংলা’র ব্যানারে তিনি নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছেন যুবসমাজকে। নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে নেওয়া অন্যতম কর্মসূচি ‘ইয়াংবাংলা’ সারাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে করে তুলেছে উজ্জীবিত। এই কর্মসূচির অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। তার নির্দেশনায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুজিব’ নামের একটি শিশুতোষ প্রকাশনা। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে গ্রাফিক নভেল সিরিজ মুজিব-৬ পর্বের পর নতুন পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে সিআরআইয়ের উদ্যোগে। জীবনীভিত্তিক এই প্রকাশনার মধ্য দিয়ে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই গ্রাফিক নভেলটি। ইংরেজির পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিদেশি ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে বইটি। আসলে রাদওয়ান মুজিব রাজনৈতিক কোনো পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকেও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর জয়বাংলা কনসার্টের আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশের তরুণদের অন্যতম বড় প্লাটফর্ম ইয়াংবাংলা। মুজিববর্ষ এবং তার আগে তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছে আয়োজিত এসব কনসার্ট। কারণ কনসার্টের বড় অংশজুড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের গান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ উপলক্ষে ২০১৮ সালে জয়বাংলা কনসার্ট আয়োজন করে ইয়াংবাংলার সেক্রেটারিয়েট সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। চতুর্থবারের মতো চলা ইয়াংবাংলার ওই আয়োজনে উপস্থিত ছিল এ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় মুখগুলো। দেশাত্মবোধে নিজের চেতনাকে আরও একবার ঝালিয়ে নিতে কনসার্টকে দারুণভাবে স্বাগত জানায় তরুণ প্রজন্ম।
রাদওয়ান মুজিব ববি ২০১৮ সালে বলেছেন, তরুণদের লবিস্ট হিসেবে কাজ করবে ‘ইয়াংবাংলা’। সে সময় তিনি মাইক্রোসফট ইয়াংবাংলা সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে ছিলেন যে সামিটে অংশ নেয় সারাদেশের ২৫০টি দল। অংশগ্রহণকারী দল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ অবকাঠামো নানা বিষয়ে উদ্ভাবনী প্রস্তাবনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। বিজয়ী দলগুলোকে সম্মাননাসহ প্রস্তাবিত আইডিয়া বাস্তবায়নের অর্থ দেয়া হয়। ২০২০ সালে মুজিববর্ষে তরুণদের চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিল রেখে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা উচিত বলে জানিয়েছেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সকলের ভাবা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
বঙ্গবন্ধু-দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির অবদানের কথা বলতে গেলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। ১৯৭৫ সালে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে দশম জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তিনি ও তার সন্তান এবং বোন রেহানা ও তার সন্তানদের নিয়েই তার পরিবার। এর বাইরে তার পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। তবে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে লিখেছেন- ‘একদিকে জনগণ এবং অন্যদিকে আমার সন্তান কাউকেই আমি ভিন্ন চোখে দেখতে পারি না।’ প্রধানমন্ত্রীর পিতা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিশারি, স্বামী পরমাণুবিজ্ঞানী, ছেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। একটি পরিপূর্ণ আলোকিত পরিবারের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী বাল্যকাল থেকেই পিতার রাজনৈতিক আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। এ জন্য শেখ হাসিনা পরিবারের ঔদার্য বিশাল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ঘটনা দিয়ে সেই উদার-হৃদয়ের মানুষদের আমরা চিনতে পারি।
মহাজোট সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার নামে বরাদ্দকৃত বাড়িটি সরকারি কাজে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার ঘটনাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে ২০০১ সালে ১১ জুলাই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমির প্লটে একতলা একটি বাড়ির মালিকানা পান শেখ রেহানা। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয় এবং বাড়িটি তার নামে ‘নামজারি’ও হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বরাদ্দ না মেনে বাড়িটি ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশকে দিয়ে দেয়। তবে শেখ রেহানার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করায় মামলাধীন বাড়িটির বরাদ্দপত্র বাতিল করতে ব্যর্থ হয় জোট সরকার। প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারিসূত্রে পাওয়া বাড়িটি নিজের দখলে আনার চেষ্টা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছেন শেখ রেহানা। নামমাত্র ১০০১ টাকা মূল্যে সরকারের কাছে বাড়িটি দলিল করে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হিসেবে তার পক্ষেই ঘটানো সম্ভব। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানও বাল্যকাল থেকে পরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন আর নিজে ধনপতি না হয়ে সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। ২০০১-০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জোট সরকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনেককেই প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কেড়ে নিয়েছিল এ দেশের গর্বিত সন্তান শেখ রেহানার বাড়িটি। মনে রাখা দরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ধানমন্ডির পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা নিজেরা ভোগদখল না করে ‘স্মৃতি জাদুঘর’ করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অথচ জাতির পিতার কন্যাদ্বয়ের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রেরই করা উচিত। আমরা দেখলাম বিপরীত চিত্র শেখ রেহানার বাড়িটি দখলের জন্য জোট সরকার ২০০৫ সালে থানা হিসেবে উদ্বোধন করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি বিদ্বেষের কারণ কী? পক্ষান্তরে শেখ রেহানা নিজের বাড়িটি স্বেচ্ছায় জনস্বার্থে পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন। এটা বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঔদার্যের প্রকাশ। ব্যক্তিগত ভোগদখলের চিন্তা ত্যাগ করার এই মানসিকতা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। এ জন্যই শেখ রেহানা বলেছেন- ‘এক সরকার দেবে, আরেক সরকার নেবে, এই ঝামেলায় তার দরকার নেই।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকতে হয়েছে বড় বোন শেখ হাসিনাসহ শেখ রেহানাকে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো কেউ তাদের প্রতি সদয় হয়নি। বরং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মাত্র ১০১ টাকায় তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য গুলশানে ৩২ কাঠার প্লটে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয়। সে সময় কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলেননি। ৩২ কাঠার গুলশানের বাড়িটি বরাদ্দ পাওয়ার পরও খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের ২২৮ কাঠার বিলাসবহুল বাড়িতেই থাকতেন। প্রচলিত আইন ভেঙে একইসঙ্গে দুটি সরকারি বাড়ি দখল করার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ একটিবারও প্রশ্ন তোলেননি কেন? অবশেষে আদালতের রায়ে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছাড়তে হলেও তিনি প্রেস কনফারেন্স করে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেনানিবাসে বসে দিনের পর দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়েও প্রতিবাদ করেননি প্রতিক্রিয়াশীল ঘরানার বুদ্ধিজীবী মহল। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের দলীয় রাজনীতির দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু কন্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ শেখ রেহানা কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ঔদার্যের তুলনাও হয় না। শেখ রেহানার মাথা গোজার ঠাঁই কেড়ে নিয়ে তাঁর নামে রেজিস্ট্রি ও নামজারিকৃত বাড়ি থেকে কর্মরত ৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় জোট সরকার। কেবল জাতির পিতার কন্যা হওয়ায় শেখ রেহানাকে সেদিন অপদস্ত করা হয়েছিল। সেই উপেক্ষা, কুরুচিপূর্ণ আচরণ মানুষ ভুলে যায়নি। জনগণ তার জবাবও দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে।
শেখ হাসিনা ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তার তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নৃশংসভাবে নিহত হন। একমাত্র বোন শেখ রেহানা তখন তার সঙ্গে জার্মানিতে। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ১৭ মে ৬ বছর নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন তিনি। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পরে তাদেরও বন্দী করে রেখেছিল পাকিস্তানি আর্মি। বন্দী মুহূর্তগুলো ছিল উৎকণ্ঠায় ভরা। পিতা জীবিত আছেন জানতে পারেন স্বাধীন দেশে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু প্রথমে পরিবার নয় গিয়েছেন জনতার কাছে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন পরিবারটির প্রেরণা। মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দেশ স্বাধীন হবে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড এবং সাউথ এশিয়ার শক্তিশালী দেশ। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে এ দেশ। বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনাও।
বাংলাদেশের মানুষের কথা চিন্তা করে শেখ হাসিনা কষ্ট পান; তেমনি রেহানাও। যে মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কষ্ট করলেন, সেই মানুষের জন্যই নিজের জীবনটাই দিয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি আমলের মতো যে কষ্ট সেই কষ্টই পেয়েছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত।১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমানে তিনি চেষ্টা করছেন মানুষের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হবে, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে- এ ভাবনা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ সকল আওয়ামী লীগ বিশ্বাসীর।
ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার মতো শেখ রেহানারও টুঙ্গিপাড়ার প্রতি রয়েছে গভীর টান। হিজলের স্মৃতি তাকে ডাক দিয়ে যায়; জলে ঢাকা সবুজ ক্ষেত তাকে আহ্বান জানায়। মহান পিতার কবর স্নিগ্ধ সান্নিধ্য প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন বলেই প্রাণে রক্ষা পান তিনি। কলেজ পড়ুয়া রেহানার লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছিল দেশে। কারণ তাদের ছোট বাড়িতে অনেক মানুষ; আর রাজনৈতিক পরিবারে বিচিত্র মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ জন্য বড় বোনের সন্তানদের দেখাশোনা ও নিজের পড়ার কাজের সুবিধার জন্য মাতৃনির্দেশ পালন করে বিদেশ পাড়ি দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গবন্ধু একটি ছোট বাড়িতে থাকতেন। কারণ বেগম মুজিবের বিশ্বাস ছিল বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাবে। এ জন্য কখনো রাষ্ট্রপতি ভবনে বসবাসের উদ্দেশ্যে যাননি বরং সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। দেশে ফিরতে না পেরে ১৯৭৬ সালে রেহানা লন্ডনে পৌঁছান। বিয়ে করেন পিতার পছন্দের পাত্রকেই। ১৯৭৭ সালে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তিনি প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন সুইডেনে একটি কনফারেন্সে। ১৯৮০ সালে শেখ হাসিনা লন্ডনে বক্তব্য রাখেন। এ সময় দুই বোন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে সোচ্চার হন। ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা পার্টির জন্য নিরলস কাজ করেছেন; নেতৃত্ব দিয়েছেন; সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। আর প্রেরণা জুগিয়েছেন ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ রেহানা লন্ডনে থাকেন। বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বোন, তারপরও তাকে চাকরি করে চলতে হয়। একটা গাড়ি নেই, তার বিরুদ্ধেও মামলা করে জোট সরকার এবং পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তার ছেলে জামাল লন্ডনে সেলসম্যানের চাকরি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাতেন। পরিবারটি এ ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বেড়ে উঠেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দেয় ২০০৭ সালের কেয়ারটেকার সরকার। অথচ তারা কোনো দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। যাদের গায়ে কালি নেই তাদের কালি দিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা। সৎ যোগ্য হয়েও তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বহুবার। এ দেশে মানুষের ভালোবাসা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবার কিছুই পায়নি। উপরন্তু শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা রাষ্ট্রের কাছে থেকে কিছুই নেননি। রাষ্ট্রপতি পরিবার হিসেবে তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে সবাই পায় শুধু তাঁরাই কিছু নেননি। কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ নেই; ছিল না কখনো। এ জন্য জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেছেন; জনগণের দিকে তাকিয়েছেন; জনগণের জন্য কিছু করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা কর্তব্য মনে করে নিজের বরাদ্দকৃত বাড়িটি পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন। শেখ রেহানার মহানুভবতার তুলনা নেই। মানবদরদী ও মহৎ ব্যক্তির আদর্শ তিনি।
বঙ্গবন্ধুর এই ছোট মেয়ের (জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫) তিন সন্তান। একমাত্র ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং দুই মেয়ে হলেন টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। ববি ১৯৭৮ সালের ২১ মে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী পেপি কিভিনিয়ামি সিদ্দিক, মেয়ে লীলাতুলী হাসিনা সিদ্দিক (জন্ম ৩১ অক্টোবর, ২০১০), ছেলে কাইয়াস মুজিব সিদ্দিক (জন্ম ৩০ মার্চ, ২০১৩)। জীবনের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে কাটালেও রাদওয়ান মুজিব শেখ রেহানার পরিবারের রাজনৈতিক আবহ ও আদর্শ নিয়েই বড় হয়েছেন। এখন একটানা এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশেই আছেন তিনি। এ সময়ে সরাসরি রাজনীতির মাঠে না থেকেও দেশ গড়ার কাজে সক্রিয়। বিশেষত বড় খালা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনায় গবেষণাভিত্তিক তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে সহযোগিতা করছেন তিনি। সিআরআই থেকে এ কাজগুলো করা হচ্ছে।
লেখাবাহুল্য, বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স (এলএসই) থেকে গ্রাজুয়েট রাদওয়ান মুজিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লন্ডনের ওই প্রতিষ্ঠানে তার অধ্যয়নের প্রধান বিষয়গুলো ছিলো গভর্মেন্ট অ্যান্ড হিস্টরি, পলিটিক্যাল থিওরিজ, ইন্টারন্যাশনাল হিস্টরি। ২০০২-২০০৩ সেশনে একই প্রতিষ্ঠান থেকে কমপারেটিভ পলিটিক্স, পলিটিক্যাল সায়েন্স, কনফ্লিক্ট রেগুলেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি প্রথম থেকেই রাজনীতিসচেতন। ২০০৮ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনাকে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারাগার থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন তখন লন্ডনে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই সময় ববি বিখ্যাত ‘ফ্রস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্যার ডেভিডকে প্রধানমন্ত্রীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যে সাক্ষাৎকার দেন যা বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার ক্ষেত্রে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে সজীব ওয়াজেদ জয়ের চেয়ে বেশি উৎসাহী মনে করা হয়। কারণ জয় অতটা মাঠের রাজনীতি বা তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা। আবার প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুল রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না থাকলেও জনসেবামূলক কাজেই বেশি নিবেদিত। মায়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক তার দেখা মেলে। যার ফলে অনেকেই বলেন রাজনীতিটা প্রধানমন্ত্রী হাতেকলমে শেখাচ্ছেন মেয়েকে। অন্যদিকে শেখ রেহানা রাজনীতিতে কখনো দলীয় পদে না থাকলেও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারিগর তাকে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী নানা সময়ে বলেছেন, ‘রেহানা আমার ছায়াসঙ্গী।’ শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির তুখোড় রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে খালা-মা ও বোনের পথ ধরে ববিই হতে পারেন আওয়ামী লীগের উত্তরসূরী। তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের নেতারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর তাকে দলে ডেকে নেয়া উচিত। তাতে আওয়ামী লীগ একজন দক্ষ নেতা পাবেন। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৯ম বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমি থাকতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। আমি চাই বেঁচে থাকতেই নতুন নেতা নির্বাচিত করে দলকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু তখন কাউন্সিলরা তাঁর বক্তব্য সমস্বরে প্রত্যাখান করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডয়চেভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি থেকে অবসরের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে চতুর্থবার আমি প্রধানমন্ত্রী। আমি আর চাই না, একটা সময় এসে বিরতি দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেন তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তার শেষ মেয়াদ, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও তরুণ নেতৃত্বের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
সবদিক বিবেচনায় তিনি না থাকলে তাঁর আদর্শকে বহন করতে পারবেন রাদওয়ান ববি। তাঁর হাতেই দেশ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত থাকবে। এই নেতা বাংলা ও বাঙালির আশার প্রতীক হবেন। ববি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে সকলের বিশ্বাস। রাজনৈতিক দক্ষতা, দলীয় আনুগত্য ও পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি) থাকায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০ তম সম্মেলন হওয়ার আগে দলীয় নেতাকর্মীরা জয় ও ববিকে দলের মূল ধারার রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় দেখতে চেয়েছিলেন। তখন থেকেই তারা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তিশীল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে এগিয়ে রাখতে তরুণ নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং শেখ রেহানাপুত্র দুজনই যোগ্য। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র হিসেবে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলে। অন্যদের দাবি সত্ত্বেও ২০১৬ সালে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না হলেও দলের বিভিন্ন কাজকর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ববি।
বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা বহমান তা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি- এই তৃতীয় প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সকল আকর্ষণ এখন কেন্দ্রীভূত। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে নেতৃত্বের বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য একটি ব্যাপক বিস্তারি প্রসঙ্গ। ভারতের দিকে তাকালে বর্তমান রাজনীতির পারিবারিক ধারা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। জওহরলাল নেহেরু গান্ধীর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময় মোরালি দেশাইয়ের মতো অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও ইন্দিরা গান্ধীই হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁর কন্যা বেনজীর ভুট্টো, বেনজীরের স্বামী ও ছেলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা যেমন সত্য তেমনি শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় লক্ষণীয়। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকেই রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আবদুল জলিল, আবদুর রাজ্জাক, কামাল হোসেন প্রমুখ বড় বড় নেতা দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনাকেই জনগণের সামনে দাঁড় করান। খালেদা জিয়া যেভাবে তারেক জিয়াকে রাজনীতিতে এনে দলের পদে সমাসীন করেছেন জয় কিংবা ববির জীবনে তেমনটি ঘটেনি। বরং জয় কিংবা ববি রাজনীতিতে নামতে পারেন ধরে নিয়ে ২০০৪ সালে ‘হাওয়া ভবনে’র মালিক তারেক জিয়াকে বিএনপি লুফে নিয়েছিল। জয় ও ববি বাংলাদেশের মৃত্তিকার সন্তান। তাঁদের রাজনীতিতে আসাটা আকস্মিক হলেও দলকে সংগঠিত করা, দলের কোন্দল মেটানো, দলকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ রাখা তাদের প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় সবসময়।
রাদওয়ান ববির ভেতর রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো জনগণের সঙ্গে মেশার তাগিদ। রয়েছে পরিশ্রমী ও তারুণ্যের প্রাণময়তা। এ জন্য লন্ডন থেকে তাঁর এদেশে চাকরি নেয়া, রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে যোগ দেয়া আমাদের জন্য শুভ সূচনা। দেশের মধ্যে যারা একসময় দুর্নীতি ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদের মসনদ কেঁপে উঠেছে তাঁর কার্যক্রমে। তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর মতোই তরুণসমাজকে আশাবাদী করে জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ করে চলেছেন। একসময় তাঁর মতো বয়সে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে জাগিয়েছিলেন; ববিও তেমনি নির্বাচনে জয়ী এবং ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিতে সক্ষম। তাঁর ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুর মতোই সম্মোহনী চেতনা স্ফূরিত হচ্ছে। তিনি এদেশে অবস্থান করেই মানুষকে উজ্জীবিত করছেন। বিএনপি-জামায়াতের গাত্রদাহের কারণ এ জন্য যে ববি উচ্চশিক্ষিত এবং যে বাংলাদেশ করোনা মহামারি জয় করে উন্নত রাষ্ট্রের পথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে তার পুরোভাগে তিনি আছেন।
আমাদের মতে, শেখ হাসিনা যেমন নির্লোভ, মানুষকে ভালোবাসেন নিজের অন্তর থেকে ববিকেও তেমনিভাবে এগিয়ে যেতে হবে। বিরুদ্ধ মানুষের মন জয় করতে হবে। এজন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে কাজে লাগাতে হবে। সাধারণ মানুষকে শেখ হাসিনা সরকারের কর্মসূচি ও সাফল্য বর্ণনা করতে হবে। অনেকে ভাবতে পারেন তিনি ব্রিটিশ সিটিজেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে শেখ রেহানা কিংবা শেখ হাসিনাও বিদেশে চলে যাবেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধুকন্যারা এই মাটি ও মানুষের নিকটজন সেহেতু ববিও তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন।
এদেশে বিএনপির মতো দলের অপপ্রচার মোকাবিলা ও সরকারের সফলতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে ভিন্ন রকম কৌশলী হতে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা সারাদেশে সফর করে অপপ্রচারের জবাব দিতে পারবেন না। তাই বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে। রাদওয়ান ববির নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে তরুণদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাদের তরুণদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশায় উজ্জীবিত করেছে। একাধিক বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি নানা প্রসঙ্গে গঠনমূলক রাজনৈতিক কথা বলেছেন। তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। যদিও তাঁকে তৃণমূল জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক মঞ্চে দেখেনি, কেবল তাঁর কথা অনুসারে শিক্ষিত যুবসমাজ কাজ করছে। তবু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মতো আন্তরিক হৃদ্যতায় সাধারণ মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। এর আগে তিনি দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আত্মসুখ ত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধুর নাতি এবং শেখ হাসিনার পারিবারিক সূত্র ববিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ তিনি যে মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে এসেছেন তা বোঝা সহজ। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের পক্ষে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করাটাই স্বাভাবিক।
ববির মতো নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব আমাদের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের পদচারণা আমাদের এগিয়ে চলার পথে বাড়তি প্রাপ্তি। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে প্রতিবছর ভোটার তালিকায় তরুণ ভোটার আসছে প্রায় অর্ধলক্ষ। প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ ভোটারের মধ্যে ৫ কোটি ভোটারের বয়স ৪০ বছরের নিচে। মোট ভোটারের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন প্রজন্মের। তাদের জন্য নতুন প্রজন্মের নেতা অনিবার্য। ববি এসব নতুন ভোটারদের প্রত্যাশার ভাষাকে ঠিকই বুঝতে পারেন। ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আগামীতে আওয়ামী লীগের কমিটিতে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় তা পালন করতে সক্ষম হবেন।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ এখনো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দল। এখানে অন্য কোনো দলের এত শক্তি নেই যে তারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সমান হতে পারে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে তা অন্য কোনো দলের নেই। ববি সেই গৌরবকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন। মধ্যবিত্তের সন্তান বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির ভয়কে উপেক্ষা করেছেন; জেল খেটেছেন মাসের পর মাস। সেই ত্যাগী নেতার নাতি হিসেবে ববিকে মনে রাখতে হবে, দেশের মূঢ়, মূক মানুষের মুখে দিতে হবে ভাষা। তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় নিয়েই। জাতির পিতা নিজের সন্তানকে (শেখ মনি, শেখ কামাল) রাজনীতিতে এনেছিলেন। আর তা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পারিবারিক পর্যায়ে তিনি যা করেছিলেন তা ছিল দেশের স্বার্থে, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে। অনেকেই তাঁর বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচারণ করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য মমত্ববোধকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। ববি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারে নিষ্ঠার পরিচয় দিবেন।
২০২০ সালের ‘মুজিববর্ষে’ সকলের প্রত্যাশা নতুন ও আধুনিক একটি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। মহামারি-কবলিত বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলা করা এ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজে জয়ী হওয়ার জন্য তরুণ জনগোষ্ঠীর নেতা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার। আগামী দিনের নেতৃত্বে মেধাবী, সৎ, ত্যাগী ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর তরুণদের সুযোগ দিলে দলের পাশাপাশি জাতি উপকৃত হবে। ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে দলকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। বিতর্কিত, দুর্নীতি ও পদবাণিজ্যে জড়িত, অযোগ্য ও সুবিধাবাদী প্রভাবশালী নেতাদের চেয়ে তরুণরা নিঃসন্দেহে বেশি অবদান রাখতে পারবেন। রাজনীতি স্থিতিশীল রাখা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল করার জন্য ভালো নেতৃত্ব দরকার। আর দেশের কল্যাণের স্বার্থেই ববির মতো তরুণকে ক্ষমতায় দেখতে জনগণ উন্মুখ।
মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও শেখ রেহানার পুত্র ববি এগিয়ে এসেছেন মানুষের আকর্ষণে। শেখ হাসিনার মমত্বময় সান্নিধ্য তাঁকে রাজনীতির শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী সমর্থক সকলেই খুশি হবেন। কারণ তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নেতৃত্ব ও উন্নয়নকে একইসঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। ববি হঠাৎ আবির্ভূত নেতা নন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর আছে দৃঢ়চেতা অভিভাবকবৃন্দ। যাঁরা সকল বিষয়ে সুপরামর্শ দিতে পারঙ্গম। কখনও পথ চলতে ছিটকে পড়লে শেখ হাসিনা পরামর্শ দিয়ে ঠিক পথে আনতে পারবেন তাঁকে। কারণ ববি একান্তই খালা অনুগত।
তবে নতুন প্রজন্মের কাছে দলের আবেদন বাড়াতে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে অনেককিছু করতে হবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগকে গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজে নামতে হবে। যোগ্য ও জনগণের নেতাকে কাছে টানতে হবে। দেশ-বিদেশের রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের কৌশলপত্র প্রণয়ন ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত হতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে বাধ্যতামূলক প্রযুক্তিমুখী করতে হবে। মূল সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর দেশব্যাপী শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। সংগঠনের দুর্বলতা কাটানোর জন্য নেতাকর্মীদের নিয়ে সংকট উত্তরণের পথ আবিষ্কার করা খুবই জরুরি। শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় ববি যেমন তৎপর তেমনি নিজের নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নতুন কাণ্ডারী রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তাঁর বিজয়ী অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।