বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পেয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের গণরায় পেলেও শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফলে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় বাঙালি নিধন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। ২৫ মার্চ রাতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে তাকে জেলে বন্দি রাখা হয়। তাকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করে গোপন বিচারও শুরু করেছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ।
তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু তার মুক্তি ও নিরাপত্তার দাবি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ আরও অনেক দেশ প্রকাশ্য এবং গোপনে করতে থাকায় শেষপর্যন্ত বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে তাকে হত্যার নির্বুদ্ধিতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেখায়নি। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও আত্মিকভাবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ দিনগুলোতে। তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। পাকিস্তানেও শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ৯ মাসের নিষ্ঠুর গণহত্যা এবং বর্বর অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তান ধিকৃত হয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিও দেশের ভেতরে-বাইরে প্রবল হয়।
৯০ হাজার যুদ্ধবন্দির কথাও পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিতে হয়। নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। তাকে স্বাগত জানানোর জন্য সেদিন ঢাকা শহরে জনতার ঢল নেমেছিল। বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল লোকে লোকারণ্য।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেখানে যে ভাষণ দেন সেটা আসলে ছিল স্বাধীন দেশ কোন পথে পরিচালিত হবে তার একটি রূপরেখা। নয় মাসের কারাভোগে তিনি ছিলেন ক্লান্ত কিন্তু ভাষণে জাতিকে ঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ভুল করেননি।
ভাষণে তিনি বলেন-
“আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।”
অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেন-
“তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই বহু কর্মী আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই তাদের আমি দেখবো না।”
আবেগময় কণ্ঠে তিনি বলেন,
“আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধহয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।”
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সবার সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“আমি আশা করি দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও – দিতে হবে, উপায় নাই দিতে হবে। আমি আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না।”
বঙ্গবন্ধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন-
“কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।”
আবেগ আপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেন-
“আজ থেকে আমার অনুরোধ- ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছো তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।”
তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন-
“আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না তাদের বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি, তাদের উপর হাত তুলো না আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি।”
তিনি অঙ্গীকার করেন-
“যারা দালালি করছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।”
পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিক অত্যাচার, কীভাবে বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছে তা দুনিয়ার মানুষকে জানাতে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক ‘ইনকোয়ারি’র আহ্বানও তিনি জানান।
দেশে ফেরায় স্বস্তি প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“আমায় আপনারা পেয়েছেন। ফিরে আসবো জানতাম না। আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে, আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান- একবার মরে দুই বার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।”
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন,-
“পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি তোমরা সুখে থাকো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না, শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।”
তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলেন-
“আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই, সাবধান বাঙালি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।”
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন-
“আমার রাষ্ট্রে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশে হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।”
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের নানামুখী অবদানের কথা একাধিকবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন-
“আমি বলে দিবার চাই আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা হয়েছে, যেদিন আমি বলবো সেদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু সরিয়ে নিচ্ছেন।”
সদ্য স্বাধীন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি সবার প্রতি আকুল আহ্বান রাখেন-
“আজ আমার কারো বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই, একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলো না। অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দিব, আইন নিজের হাতে তুলে নিও না।”
গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেছিলেন-
“নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে- এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি এই আশীর্বাদ, এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন। এই কথা বলে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিবার চাই। আমার সহকর্মীদের আমি ধন্যবাদ জানাই, যাদের আমি যে কথা বলে গিয়েছিলাম তারা সকলে একজন একজন করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে, মুজিব ভাই বলে গিয়েছে তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দাও, বাংলার মানুষকে মুক্ত করো।”
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসেছিলেন। দেশের মানুষ তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে স্বস্তি পেয়েছিল, উৎফুল্ল হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির যে উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু যে ন্যায়পরায়ণ ও ন্যায্য সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।