১৯৭১। সময়টা ছিল যুদ্ধমুখর। কয়েক দশক ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম চলছিল। একদিকে কমিউনিস্টদের বিপ্লব চলছিল, অন্যদিকে মুক্তির জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল বিশ্বের বেশ কয়েকটি রণাঙ্গণ। তবে, বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের স্বাধীনতার এই যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল এই যুদ্ধে। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী তথা বাঙালি জাতির দীর্ঘকালের সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য যে সংগ্রামের সূচনা করেন, সেটাকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যান স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে। দেড় যুগের বেশি সময় নিয়ে জাতির মনন প্রস্তুতের পর ঘোষণা করেন ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ ছয় দফা। জনগণের তুমুল অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে থাকেন নেতা। পাকিস্তানি শোষক ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র, মামলা, জেল-জুলুম মোকাবিলা করে নির্বাচনে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই জোরদার করেন গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সাত কোটি বাঙালি প্রত্যেকে পরিণত হয় একেকটি আদমবোমায়। মার্চের শুরুতেই দেশের একক নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বঙ্গবন্ধুর হাতে। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন নির্দেশনা দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য জাতিকে গড়ে তোলেন তিনি। এরপর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বাংলাদেশের। শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে, সেই থেকে আমরা বিশ্বের বুকে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করি।
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, সাদা পোশাকে ঢাকা ছেড়ে চলে যায় পাকিস্তানি স্বৈরাচার জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সন্ধ্যার পর থেকেই থমথমে হয়ে ওঠে শহর। তৎকালীন সাংবাদিক অ্যান্থনি মারকারেনহাসের গ্রন্থে সেদিনের ব্যাপারে বিষদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি লেখেন, রাত সাড়ে আটটার দিকে এক রিকশাচালক দ্রুত পায়ে প্যাডেল চালিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে এসে থামে। বঙ্গবন্ধুর জন্য জরুরি বার্তা বহন করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এত পথ সে রিকশা চালিয়ে এসেছে। তিনি বঙ্গবন্ধু জানান, ‘আজ রাতে আপনার বাড়িতে হামলা হবে।’
এদিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি বিষয়ে তথ্য জানাতে একের পর এক ফোন আসছিল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে। পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তাকেও আত্মগোপনে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বললেন, ‘আমি কোথাও যাব না। আমি যদি আত্মগোপন করি, তাহলে ঢাকা শহর থাকবে না। তারা তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করবে। বহু বাড়ি-ঘরে ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রচুর প্রাণহানি হবে।’ পরবর্তীতে পাকিস্তানি লে. জেনারেল টিক্কা খানের এক সাক্ষাৎকারের বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর এই আশঙ্কার সঙ্গে মিলে যায়। কসাই টিক্কা খান নিজের স্বীকারোক্তিতে বলেছে, সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকে না পাওয়া গেলে ঢাকার প্রতিটা ঘরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া হতো।
অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পার্থক্য এখানেই- পর্বতপ্রমাণ নেতৃত্ব গুণ ও দূরদর্শিতা। সেই রাতে, খুব সময়োপযোগী ও দুর্দান্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতেন, একটা দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার আত্মগোপনে যাওয়া ঠিক হবে না। এছাড়াও তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, যা যা করা দরকার তা তিনি ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন। এসবের মধ্যেই তিনি খবর পেলেন, ইপিআরকে ডিজআর্ম করা হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। কৌশলগত কারণে, আগে আক্রমণের ঘোষণা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের ধুয়া তুলো বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে অপপ্রচারের সুযোগ দেননি তিনি পাকিস্তানিদের, কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে আর দেরি করলেন না বঙ্গবন্ধু। পুরো মার্চ মাসজুড়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষকে পর্যন্ত প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। পাকিস্তানি কর্তৃক আক্রমণের খবর পাওয়া মাত্রই চূড়ান্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিলেন। হাজার বছরের ইতিহাসের এই মহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলেন। এই মোক্ষম সময়ের জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি, প্রতীক্ষায় ছিল সাত কোটি বাঙালি। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে, অয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষিত হলো স্বাধীনতার ঘোষণা। এর পরপরই, সেই বার্তা টুকে নিয়ে করে বিলি করা হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক বিশ্বে। জান্তাদের আর কিছুই করার থাকলো না। এমনকি কূটনৈতিকভাবেও বঙ্গবন্ধুএবং বাঙালি জাতিকে নিয়ে অপপ্রচারের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো জান্তাদের জন্য।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা
পাকিস্তানি জান্তারা ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণে নামার পর, বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার বাংলা অনুবাদটি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার সেই ঘোষণাটি হলো (অনুদিত):
‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। -শেখ মুজিবুর রহমান, ২৬ মার্চ ১৯৭১’
এই ঘোষণাটি সম্প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন পিলখানার সিগন্যাল কোরের বাঙালি অফিসারদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি সুবাদার মেজর শওকত আলী। রাত সাড়ে ১২টার দিকে অয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত খবর পাঠানোর সময় তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। তবে একাধিক বিকল্প ব্যবস্থা প্রস্তুত ছিল। এই ব্যাপারে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তার ‘একাত্তরের মার্চ: যেন এক অনন্ত যাত্রা’ নিবন্ধে সেই রাত ও স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। সেখানে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রকৌশলী এ কে এম নুরুল হক খুলনা থেকে একটা পরিত্যক্ত ট্রান্সমিটার নিয়ে এসে রেখেছিলেন ঢাকায়। রেজিস্ট্রার বুকে যার কোনো হিসাব লেখা ছিল না। সেই ট্রান্সমিটারটিকে সচল করে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন প্রকৌশলী এ কে এম নুরুল হক। এবং কখন কী করতে হবে সে সম্পর্কেও অবহিত ছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ রাতে নুরুল হক ফোন করেন বঙ্গবন্ধুর বাসায়। ফোনটা ধরেন বঙ্গবন্ধুর অবৈতনিক সহকারী হাজী গোলাম মোর্শেদ। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুকে বলেন, মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি, এখন মেশিন কী করব? বঙ্গবন্ধু তখন পাশেই ছিলেন। তিনি গোলাম মোরশেদকে বললেন, ‘তাকে বলো, মেশিন ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে।’
সেই রাতে অয়্যারলেসের মাধ্যমে ইংরেজিতে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেওয়া হয়, সেই বিষয়ে ব্রিটেনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ‘…শব্দ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত, ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল।’ সেই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এডওয়ার্ড হিথ। তিনি পরবর্তীতে মন্তব্য করেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ইউরোপের জেনারেলরা মনে করেন, শেখ মুজিব জীবিত থাকুন বা না থাকুন, তারা (পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা) আর বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণ পরাজিত করতে সমর্থ হবে না।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদের বর্ণনা
১৯৭১ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনরের দ্বায়িত্ব দেয় স্বৈরাচার জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পরের দিনই গভর্নর ও হানাদার বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঢাকায় আসে টিক্কা খান। এর আগে, ১৯৭০ সালে বেলুচিস্তানে গণহত্যা চালানোর জন্য বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে এই সেনা কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হয় সে। পরবর্তীতে পাঞ্জাবের গভর্নর করা হয় তাকে। এসময় সার্ক সম্মেলনের একটি অনুষ্ঠানের পর, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার প্রসঙ্গে তাকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। পাঞ্জাবের সরকারি গভর্নরের হাউজের দোতলায় বসে ওই রাতের অভিযানের কথা স্বীকার করে টিক্কা খান। সেই রাতে নিজের কানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার কথাও জানায় সে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে টিক্কা খান বলেছে, ”আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল- ‘স্যার, শুনুন! শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন।’ এবং আমি নিজেও রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। শেখ সাহেবের কণ্ঠ আমি ভালো করেই চিনতাম। শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।”
তবে সেই রাতে অন্যান্যদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান আত্মগোপনে চলে গেলে পাকিস্তানিদের করণীয় কী হতো, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টিক্কা জানায়, ‘আমি ভালো করেই জানতাম, শেখ মুজিবের মতো নেতা তার নিজের লোকদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার জন্য ঢাকার সব জায়গায়, প্রতিটি বাড়ি-ঘরে, এমনকি প্রতিটি কোণায় কোণায় তল্লাশি চালাতাম। অন্য কোনো নেতাদের গ্রেফতার করার ইচ্ছা ছিল না আমার। এজন্য তারা খুব সহজেই ঢাকার বাইরে চলে যেতে পেরেছিল।’
দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও বাংলাদেশের কিছু লোক পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিল বলেও জানায় সে। সেই সাক্ষাৎকারে টিক্কা খান আরো বলেছে, ‘বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা আমাদের সঙ্গে ছিলেন।… গোলাম আজমসহ অনেকে এখনো মনে করেন না যে আমরা ভুল করেছি।’
উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ও এই অঞ্চলের হানাদার বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল টিক্কা খান। তার নির্দেশেই ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু হয়। পরে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ওরফে একে নিয়াজি। নিয়াজি এবং রাও ফরমান আলী খানরা (নিয়াজির উপদেষ্টা) বেশ আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছিল।
পুরো সময়টাই তাদের সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। পরবর্তীতে, যুদ্ধ-দিনের স্মৃতি নিয়ে ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের নারকীয় হামলা থেকে শুরু করে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, হানাদার বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অনেক ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে।
২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতের ব্যাপারে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘রাস্তায় দেরি হতে পারে এই ধারণার কারণে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা থেকে সেনানিবাস ত্যাগ করতে শুরু করে অনেকে। ইতোমধ্যে যারা বেতার, টেলিভিশন কেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ, ব্যাংক ইত্যাদির নিরাপত্তার জন্য শহরে অবস্থান করছিল, অপারেশন শুরু হওয়ার আগেই তারা নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যায়।… নির্ধারিত সময়ের আগেই হামলা শুরু হয়। যেনো ইচ্ছাকৃতভাবে নরকের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হলো..’
পাকিস্তানি হানাদাররা ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলে পড়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলেও উল্লেখ করেন একে নিয়াজির প্রেস সেক্রেটারি সিদ্দিক সালিক। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম গুলিবর্ষণের পরপর, পাকিস্তানের সরকারি বেতারের কাছাকাছি তরঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়। মনে হলো রেকর্ডকৃত বাণী। শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’
২৬ ও ২৭ মার্চের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সংবাদ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। স্বাধীনতা ঘোষণার কিছুক্ষণ পর পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পাকিস্তান রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
(The Pakistan radio announced today that Sheikh Mujibur Rahman, the nationalist Leader of East Pakistan, had been arrested only hours after he had proclaimed his region independent and after open rebellion was reported in several cities in the East… The 51-years-old leader of the Awami League, the dominant party in the East, was arrested as the West Pakistan-dominated army sought to reassert control in the East.)
দ্য ডেইলি টাইমস: ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দ্য ডেইলি টাইমস এর সংবাদে বলা হয়েছে, বীরোচিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জবাব দিয়েছেন বাঙালি জাতির সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
(Sheikh Mujibur Rahman, the Acknowledged leader of Bengali nationalism responded heroically to the Pakistan Army’s Intervention with a call for resistance and Declaration of Independence. There is a good evidence that most members of the Bengali regiments will accept his orders. Shortly before his arrest Mujib had issued a proclamation to his people, which informed them: You are citizens of a free country. Today the West Pakistan’s Military is engaged in genocide in Bangladesh. Our struggle is most rewarding, certain is victory. Allah is with us. The world public opinion is with us. Joy Bangla victory of Bengal.)
দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস: ২৭ মার্চের সংবাদে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিলে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
(Civil war after East Pakistan declares independence.)
দ্য প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া: ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে সকালেই সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতের গণমাধ্যম দ্য প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া। খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের নিকটবর্তী একটি বিশেষ বেতার বার্তার মাধ্যমে তিনি এই ঘোষণা দিয়েছেন।
(Sheikh Mujibur Rahman tonight proclaimed East Pakistan the Sovereign independent people’s Republic of Bangladesh, according to a clandestine radio report monitored near the East Pakistan.)
দ্য গার্ডিয়ান: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণাকে কেন্দ্র করে ২৭ মার্চ সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্রিটেনের অন্যতম পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান। পত্রিকাটি জানায়, গ্রেফতার হওয়ার আগে মুজিব তার দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘আজ থেকে তোমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।’
(Shortly before his arrest, Mujib had issued a proclamation to his people, which informed them: you are citizens of a free country.)
দ্য স্টেটসম্যান: ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয়, হানাদার বাহিনী কর্তৃক ক্রাকডাউনের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
(Bangladesh declares freedom: Rahman’s step follow’s Army crackdown.)
বিবিসি ও এনডিপি-এর সংবাদ: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ৯টা ৭ মিনিটে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি, এনডিপি ও পিটিআই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রচার করে। ২৬ মার্চ রাত ৮টা ২১ মিনিটে ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়ার সংবাদে বলা হয়: স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দলিল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ)-এর স্পট রিপোর্টে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিআইএ স্পট রিপোর্ট ৪৩ এর ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
(Pakistan was thrust into civil war today when Sk. Mujibur Rahman proclaimed the East wing of the two part country to be ”The sovereign independent people’s Republic of Bangladesh.
ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার
চট্টগ্রামের সলিমপুর অয়্যারলেস স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুল কাদের জানান, ২৬ মার্চ ভোরে ঢাকার মেজবাহ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটির একটি বার্তা তার কাছে পৌঁছেছে। তিনি ঘোষণাটি বললে আমি দ্রুত তা লিখে নিলাম। এছাড়াও মেজবাহ উদ্দিন সাহেব আরো জানান, তিনি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অয়্যারলেস স্টেশনের ভিএইচএফ নেটওয়ার্কের সার্ভিস চ্যানেল ও মেরিটাইম মোবাইলে বার্তাটি প্রেরণে সক্ষম হয়েছেন। বার্তাটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থানকারী বিদেশি জাহাজ এম ভি সালভিস্তা, এম ভি মিনি লা ট্রিয়া, এম ভি ভি ভি গিরিসহ আরো বেশ কয়েকটি জাহাজের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পরে বিভিন্ন কণ্ঠে পাঠ করা হয়
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সম্প্রচারের পর, সেটি দ্রুত কপি করে বিভিন্ন অঞ্চলে হ্যান্ডবিল আকারে বিতরণ করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে কয়েকদিন ধরে পাঠ করেন একাধিক ব্যক্তি। এ ব্যাপারে তৎকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ লিখেছেন, ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের হ্যান্ডবিলটিও বারবার প্রচারিত হয়েছিল আমাদের বিভিন্ন জনের কণ্ঠে। তাদের মধ্যে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ও জিয়াউর রহমানকে দিয়েও এই ঘোষণা পাঠ করানো হয়েছে।