।।মিল্টন বিশ্বাস।।
মুজিববর্ষে গবেষক-সাহিত্যিক ও অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব’ (২০২১) প্রবন্ধ গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধু গবেষণায় অনন্য সংযোজন। হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন উজ্জ্বল এক অধ্যায়। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন। কিন্তু ক্রমে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছিল স্বাধিকারমুখী। শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক, আর দ্বিতীয় পর্বের প্রধান নেতা। কিন্তু কোনো কোনো সমালোচক ইতিহাসের এই সত্যকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন। ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষের এই গ্রন্থে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য ভূমিকা যুক্তিনিষ্ঠ এবং তথ্যসূত্রের আলোকে উপস্থাপিত হয়েছে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা বর্তমান গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণনার জন্য অধ্যায় বিভাজন করা হয়েছে এভাবে- অবতরণিকা, প্রথম অধ্যায় : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও সমকালীন রাজনীতি, দ্বিতীয় অধ্যায় : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব : ১৯৪৭-১৯৫২, তৃতীয় অধ্যায় : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব : ১৯৫২-১৯৫৬, চতুর্থ অধ্যায় : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু : ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা, উপসংহার, পরিশিষ্ট, আলোকচিত্র। এ সম্পর্কে লেখক বলেছেন-
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব শীর্ষক বর্তমান গ্রন্থে ‘অবতরণিকা’, ‘উপসংহার’, ‘পরিশিষ্ট’ ও ‘চিত্রমালা’ অংশ ব্যতীত মোট চারটি অধ্যায় রয়েছে। ‘অবতরণিকা’ অংশে বর্ণিত হয়েছে গ্রন্থটির তাত্ত্বিক কাঠামো ও সাংগঠনিক রূপরেখা। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও সমকালীন রাজনীতি’। এ অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিশদ পটভূমি এবং সমকালীন পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল ঘটনাস্রোত ও স্বরূপবৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এখানে অঙ্কিত হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম যথাক্রমে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দালন ও শেখ মুজিব : ১৯৪৭-১৯৫২’ এবং ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব : ১৯৫২-১৯৫৬’। এই অধ্যায়দ্বয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দুই পর্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ও অবদান কালানুক্রমিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে লেখক-গবেষকদের রচনায় দ্বিমাত্রিক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বামপন্থী বলে পরিচিত অধিকাংশ লেখক-গবেষক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকাকে নানা কৌশলে অস্বীকারের চেষ্টা করেছেন; আবার একদল লেখক অতি উৎসাহী হয়ে তাঁর ভূমিকাকে নিজেদের মতো করে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে এসব বিষয় সূক্ষ্মতার সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু : ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনাস্রোত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মৌল চেতনা যে তিনি অন্তরে লালন করেছেন আমৃত্যু, উত্তরকালীন তাঁর নানা কর্মকা- ও বক্তব্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ কারণেই সচেতনভাবে রচিত হয়েছে পঞ্চম অধ্যায়টি। ‘উপসংহার’অংশে উপস্থাপিত হয়েছে সমগ্র আলোচনার সারাৎসার। ‘চিত্রমালা’ অংশে মুদ্রিত আলোকচিত্রসমূহও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভ্রান্ত প্রমাণ।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বিষয়ে এতকাল যে তথ্য ও উপাদান পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন তথ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থত্রয় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন) এবং শেখ হাসিনা সম্পাদিত Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman শীর্ষক গ্রন্থের যে খণ্ডসমূহ প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে এ বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ নানা তথ্য পাওয়া যায়, যা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ভূমিকাকে অভ্রান্তভাবে প্রমাণ করে। বর্তমান গ্রন্থে উপর্যুক্ত তথ্য-উৎস থেকে নানা উপাদান ব্যবহারের ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা-বিষয়ক আলোচনায় নতুন মাত্রা সঞ্চার করা গেছে বলে আমরা ধারণা করি।
প্রসঙ্গত একটি কথা এখানে স্পষ্ট করা প্রয়োজনÑবর্তমান গ্রন্থে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। গ্রন্থের শিরোনাম তা দাবিও করে না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পর্ক এবং তাঁর ভাষা ও সাহিত্যভাবনায় এই আন্দোলনের উত্তরপ্রভাব সন্ধানই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে এই লক্ষ্যে অনুপ্রবেশের জন্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্রমিক রূপরেখা এবং সমকালীন রাজনীতি সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ভাষ্য জরুরি বলে আমাদের মনে হয়েছে, যা আমরা করেছি গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে। পুনরুক্তির সম্ভাবনা এড়ানোর জন্য রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যেসব অনুষঙ্গের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, প্রথম অধ্যায়ে তা অতি সংক্ষেপে বলা হয়েছে; কেননা অভিন্ন বিষয়ই তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে, এবং তা-ই ছিল এ গ্রন্থ রচনার মূল উদ্দেশ্য। এ সিদ্ধান্তের জন্য কেউ পীড়িত কিংবা প্রতিবাদী হতে পারেন, কিন্তু এটাই যথার্থ এবং সংগত বলে আমরা বিবেচনা করেছি।’ (বিশ্বজিৎ ঘোষ, ২০২১ : ২২-২৪ )
মূলত বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণসমাজকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের এই গ্রন্থটি সহায়ক হবে। আর বঙ্গবন্ধু গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সহায়কগ্রন্থ হিসেবে গণ্য হচ্ছে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব’ গ্রন্থটি।
(রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, বিশ্বজিৎ ঘোষ, ২০২১, ঢাকা : ধী প্রকাশ)