ঐতিহাসিক ৭ জুন, ১৯৭২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা
আমার ভাই ও বোনেরা,
আজ ৭ জুন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৬৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ ছয় দফা ঘোষণা করেছিল। এই ঘোষণায় সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠী ক্ষেপে গিয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরাও তাদের বুঝতে পেরেছি। তারা জানতে পেরেছিল, বাঙালিদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই আইয়ুব খান ও মোনেম খান তাদের সৈন্য বাহিনী নিয়ে আমার লোকদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। আমি তখন কারাগারে বন্দী হয়ে যাই।
আপনাদের নিশ্চয়ই আরও মনে আছে, আমাকে যশোহরে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তারপর যশোহর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকা থেকে আমাকে সিলেট নেওয়া হয় এবং সেখানেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। সিলেট থেকে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় এবং ময়মনসিংহেও আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনি করে গ্রেপ্তারের পালা চলে। সঙ্গে সঙ্গে ৭ মে তারিখে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন, জহুর আহমেদ চৌধুরী, খোন্দকার মুশতাক আহমদ প্রমুখ নেতাও গ্রেফতার হন। পরে আমার সহকর্মী বন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরী, শামসুল হক, মোল্লা জালালউদ্দিন, মনসুর আলী, মরহুম আবদুল আজিজ (চট্টগ্রাম), মরহুম আমজাদ হোসেন (যিনি পাবনায় মৃত্যুবরণ করেছেন) এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্র ও শ্রমিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয় ।
শুধু তাই নয়। ৭ জুন তারিখে তেজগাঁও, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নারায়ণগঞ্জ, মুক্তাগাছা এবং আরো অনেক জায়গাতে গুলি করে আমার শত শত ভাই বোনকে হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, গুলি করে বাঙালিদের দাবিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা পারেন নাই। সেই দিন শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম। অনেকে হয়তো বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু আমরা জানতাম, এ ব্যাপার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এই জন্যে ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হয়।
এর পরে আমি যখন গ্রেপ্তার হয়ে চলে যাই, আমার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী সভাপতি হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।তারপর যিনিই আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সম্পাদক হয়েছেন, তাঁকেই গ্রেপ্তার করে জেলে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে তার মধ্য থেকে একদলকে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান সরিয়ে নিয়ে যান। তাতেও আমাদের দাবাতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। আপনাদের সব ইতিহাসই মনে আছে। সেইদিনও আপনারা শুনেছেন, অনেক দল আইয়ুব খানের টাকা খেয়ে ছয় দফা ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আপনাদের এ কথাও জানা আছে যে, ৭ জুন তারিখে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল।
তারপর আসুন ১৯৬৮-৬৯ সালের ঘটনাগুলির কথায়। সে সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগও আন্দোলনে যোগদান করে এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়। তারপর আইয়ুব খান আগরতলা মামলা থেকে আমাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। সেদিনও আমার দেশের বহু লোককে জীবন দিতে হয়েছে। রক্ত আমাদের অনেক দিতে হয়েছে। বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার জন্য যত রক্ত দিতে হয়েছে, কোনো দেশ, কোনো জাতি তা দেয় নাই।
আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। লোকে বলে, মানুষের স্মৃতিশক্তি নাকি দুর্বল। সে নাকি অল্প দিনেই সব ভুলে যায়। কিন্তু কেমন করে ভুলবে? ২৩-২৪ বৎসর আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমি সংগ্রাম করেছি। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১২-১৩ মাস সোহরাওয়ার্দী সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বক্ষণই উজানে আমাদের নৌকা বাইতে হয়েছে এবং বার বার গ্রেপ্তার হতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। সে ইতিহাস আজও অম্লান রয়েছে।
নির্বাচন বানচাল করবার চেষ্টা
তারপর যখন নির্বাচনে আপনারা আমাকে ভোট দিলেন, তখনও একদল লোক নির্বাচন বানচাল করবার চেষ্টা করেছিল। আমি বলেছিলাম, দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, বাংলার মানুষ এক, বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চায়, বাংলার মানুষ তাদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার আমাকে দিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে এসব প্রমাণও হয়ে গেল কিন্তু ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। ইয়াহিয়া খান সাহেব এসে গদিতে বসলেন। অর্থাৎ এক খান গেলেন আর এক খান এলেন। ইয়াহিয়া খান এসে শুরু করলেন নির্বাচনের কথা। মিষ্টি কথা, ফিস ফিস কথা, ছোট ছোট কথা, বড় বড় কথা। আর, সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য বাড়াতে লাগলেন বাংলার বুকে, আমার উপর আঘাত হানার জন্য। আমরা প্রস্তুত হলাম। আমরাও এখানে দাঁড়িয়ে শপথ নিলাম ৩ জানুয়ারি তারিখে, যে আদর্শে বাংলার মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে তাতে আপোস নাই ।
আপনারা জানেন, ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান তিনি মনে করেছিলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রী বললেই আমি গলে গদ গদ হয়ে যাব আর আমার দাবি ছেড়ে আমি তাঁর সঙ্গে হাত মেলাব। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতেন না। আওয়ামী লীগকেও জানতেন না। তাঁর এটাও জানা ছিল না যে, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মুজিবুর রহমান রাজনীতি করে নাই। আমি রাজনীতি করেছি বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার জন্য, বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা দেবার জন্য, বাংলার মানুষের জন্য। শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। বাংলার মানুষ যাতে মানুষের মতো দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে তার জন্য এবং বাংলার সম্পদ যাতে পশ্চিমারা লুট করে খেতে না পারে তারই জন্য আমি সংগ্রাম করেছিলাম; প্রাধানমন্ত্রী হবার জন্য সংগ্রাম করি নাই।ভায়েরা আমার,
এরপর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এবং তারপরের ঘটনাগুলি সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু বলবার চেষ্টা করবো। সে সবের আলোচনায় আপনাদের বেশি সময় আজ আমি নেব না। কারণ, আরও অনেক কথা আপনাদের বলতে হবে। জেল থেকে বের হয়ে এখানে এসে আমি সামান্য কয়েকটি কথা বলেছিলাম। সেদিন আমি বেশি কিছু বলতে পারি নাই। কারণ, মাঝে মাঝে আমার চোখে পানি এসে গেছে। তারপরে ভারতের মহীয়সী নারী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যখন এখানে আসেন, তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আপনাদের সামনে এসেছিলাম এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করেছিলাম । তিনি অতিথি। তাঁর সামনে অন্য কথা বেশি বলা যায় না।
মুক্তি সংগ্রামের সূচনা
আজ দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনাদের জানা দরকার। ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে। ২৫ মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী আমার উপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাত্রে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল সেটা কেবল আমিই জানি। আমি জানতাম, ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত্রি ১১টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুম দিলাম- ‘বের হয়ে যাও। যেখানে পার, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার, স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো ।
রাত্রে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ইপিআর বলা হতো, তাদের সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানা হেডকোয়ার্টার তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি যখন পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে বললাম : ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন- তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়্যারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হোক, সৈন্যবাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হোক, ছাত্র হোক; যে যেখানে আছে, পশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। বাংলাদেশ। স্বাধীন।’ তারা আমার কথামতো খবর পৌছিয়েছিল । সে রাত্রে কেবল আমার বাড়িতে নয়; রাজারবাগ, পিলখানা, আওয়ামী লীগের অফিস আর ছাত্রাবাসেও আক্রমণ চলে। বেছে বেছে আওয়ামী
লীগের নেতাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রাজারবাগের পুলিশরা ছয় ঘণ্টা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন-চারটে ব্যাটেলিয়ন ছিল। হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের অর্ধেককে মেরে ফেলা হয়।
এমনি করে সমস্ত বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক-কৃষকদের মেরে ফেলা হয়। আমার সহকর্মীরা পালিয়ে মুজিবনগরে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন সরকার কায়েম করেন। নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হন আর তাজউদ্দীন হন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং খোন্দকার মুশতাক আহমদকে নিয়ে সরকার গঠিত
দালালদের সমালোচনা
এখন সমালোচনা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাদের কাউকে এসব কাজে দেখা যায় নাই। তাঁদের কেউ যুদ্ধে এগিয়ে আসেন নাই। তাঁরা কেবল প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মুজিবনগরে বসে আবার সকলকে একতাবদ্ধ করে তাঁরা যুদ্ধ শুরু করেন। সারা দুনিয়ায় লোক পাঠিয়ে বাংলাদেশের কথা সবাইকে জানিয়ে দেন। সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লোক পালিয়ে পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম আর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তারা স্ত্রী-পুত্র কন্যার হাত ধরে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। সারা বাংলার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। নদীতে লাশ, ঘরে ঘরে লাশ। মানুষের মা-বোনের আর্তনাদ! চারদিকে হাহাকার, সর্বহারার আর্তনাদ। তবু সেদিন সমালোচকদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই। তারা বরং ইয়াহিয়া খানের দালালি
তার পরের যুদ্ধের ইতিহাস আপনারা জানেন। পাক বাহিনী ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিল। লোক দেশ ত্যাগ করল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো। শ্রমিক আর ছাত্রদের গুলি করে মারা হলো। আজ অনেকেই সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন আর এমসিএ-দের এবং আওয়ামী লীগকে গালি দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ত্যাগের কথা কারও মুখে শোনা যায় না। আওয়ামী লীগের এমসিএ আমার সহকর্মী মশিউর রহমানকে দুই মাস পর্যন্ত মারতে মারতে হত্যা করা হয়েছে। আমার আর একজন এমসিএ আমিনউদ্দিনকে আধামরা করে জিপের পিছনে বেঁধে তিন মাইল ঘুরিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমার এক চাচাকে ছয় টুকরো করে ছয় রাস্তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। সৈয়দপুরের এমসিএ নজমুল হুদা সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুই ভাগ করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন যারা বড় বড় কথা বলেন, তখন তাঁরা কোথায় ছিলেন? সবাই স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন। কিন্তু এ বি চোরাকারবারীর স্বাধীনতা? মুনাফাখোরের আর মজুদদারের স্বাধীনতা? রাজাকারের আর আলবদরদের স্বাধীনতা? আমি কিছু বলি না— এই জন্য কি তারা ভেবেছে আমি নরম মানুষ! আমি নরম মানুষ নই। আমি তাদের খেলতে দিয়েছিলাম ।
আমাকে আপনরা ‘জাতির পিতা’ আখ্যা দিয়াছেন আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য আসি নাই। আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ভালোবাসি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। জীবনে কখনো আমি তাদের সাথে বেইমানি করি নাই। চারবার আমাকে ফাঁসি দেবার চেষ্টা হয়েছে। তবু আমি মাথা নত করি নাই। তা সত্ত্বেও কেন এত কথা বলা হয়?
যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি
জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম, আমার কর্তব্য বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ দুনিয়ার আকাশে ওড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ আমি বলতে পারি- আমি বাঙালি। আজ আমি বলতে পারি— বাঙালি একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি- বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই। আপনারাও আমাকে সব দিয়েছেন। আপনারা তো আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছেন। প্রাধানমন্ত্রিত্ব তো আমার জন্য বড় জিনিস নয়। যা কোনোদিন কোনো মানুষ পায় নাই, তা আমি পেয়েছি। আপনারা যা দিয়েছেন, সে হলো আপনাদের ভালোবাসা। আমাকে আপনারা দোয়া করবেন। আমি যেন আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে মরতে পারি। এর বেশি কিছুই আমি চাই না।
জেল থেকে বের হয়ে এসে আমি দেখেছিলাম, রেলওয়ে ভেঙে গেছে, চালের গুদাম নাই, দোকানে মাল নাই। ব্যাংকের টাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়েছে। আমি আরও দেখেছিলাম মানুষের কাছে বন্দুক। আমার দেশের লোক আমাকে ভালোবাসে। তাই আমার সহকর্মীরা বললেন, তোমাকেই সবকিছুর ভার নিতে হবে। তার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব নিতে বাধ্য হলাম। বিশেষ করে এই জন্য যে, আমার বাংলার স্বীকৃতি দরকার। আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবেদন জানালাম, তোমাদের অস্ত্র ফেরত দাও। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে আমার বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা দুই লক্ষ অস্ত্র আমার হাতে দিয়েছে। অস্ত্র সমর্পণের এমন নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর দেখা যায় না।
আমাদের গুদামে চাল নাই। পকেটে পয়সা নাই। পোর্ট ভেঙে দিয়েছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিয়েছে। রেলগাড়ি চলে না। রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে না। চট্টগ্রাম ও চালনা পোর্টের মুখে সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে রেখে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাবো কী করে? দস্যুর দল মানুষ হত্যা করে খুশি হয় নাই। আমার সম্পদ ধ্বংস করে লুট করে নিয়ে গেছে। অথচ আজ একদল লোক এসবের জন্য ভারতকে দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এক কোটি লোককে মিসেস গান্ধী খাবার দিয়েছিলেন, কাপড় দিয়েছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন। এসব কি তারা দেখে আসে নাই?
খাদ্য ও ত্রাণ
আমার দেশ স্বাধীন দেশ ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট বৃটেন হোক, কারো এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে থাকি, ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু বন্ধুরাষ্ট্রকে বন্ধু বলতে লজ্জা করা উচিত নয়। যেদিন আমার সরকার ক্ষমতায় আসে, সেদিন এক ছটাক চাল ছিল না। আমি তাই ভারতের কাছে চাল চাই। ভারত তখন আমাদের সাড়ে সাত লক্ষ টন চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে আমি এক কোটি বাষট্টি লক্ষ মণ চাল পেয়েছি। এই চাল গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনরড’ও চাল দিয়েছে। রাশিয়াও আমাকে সাহায্য করেছে। রাশিয়া আমার বন্দর সাফ করে না দিলে আমি খাবার আনতে পারতাম না। আমার বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমাদের সাহায্য করেছে। তবু একদল লোেক তাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এ বন্ধুত্ব নষ্ট করবার ক্ষমতা কারও নাই।
বাংলার মানুষকে আমি জানি। আমাকেও বাংলার মানুষ চেনে। বাংলার মানুষকে আমি ভালোবাসি বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আমি তাদের জন্য কোনো কাজে হাত দিয়ে কখনো হাল ছাড়ি না। আপনাদের কাছে আমি প্রথম দিন বলেছি— তিন বৎসর আপনাদের কিছুই দিতে পারবো না। পরে সারা বাংলাদেশেই আমি এই কথা বলেছি। কিন্তু পারবো না বললেও আমি দিয়েছি। রিলিফের জন্য, ঘর-বাড়ি তৈয়ার করার জন্য এই ছয় মাসে ঊনত্রিশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টেস্ট রিলিফের জন্য গ্রাম অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। স্কুল-কলেজের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। রিলিফ ক্যাম্পের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। মোট ৭৫ কোটি টাকা এই ছয় মাসে দেওয়া হয়েছে। রিলিফ, কৃষি ঋণ এবং সমবায় ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। এছাড়া, যত বকেয়া খাজনা ছিল সব মাফ করে দিয়েছি। একদিন এই ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম— ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেব। তা আমি দিয়েছি। আমাদের বন্দর ঠিক হয়ে গেছে। এখন বিদেশ থেকে মাল আসতে পারবে। আমার তেল ছিল না, ভারত তেল দিয়েছে। আমাকে সব জিনিসই অন্যের কাছ থেকে আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তো কলোনি ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার ছিল। পশ্চিমারা সেখানে মাল তৈয়ার করত আর বাংলাদেশে সেই মাল বেচে পকেটে টাকা নিয়ে উড়ে চলে যেত। আজ জিনিসপত্রের ঘাটতি পড়েছে। সব জিনিসই আমাকে বাইরে থেকে আনতে হবে।
শিল্প জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি
আমার শ্রমিক ভায়েরা, কৃষক ভাইদের জন্য আমি টেস্ট রিলিফ দিচ্ছি, তাকাবি ঋণ দিচ্ছি, খাজনা মাফ করেছি। এই সঙ্গে ব্যাংক জাতীয়করণ করেছি। বড় বড় শিল্প কারখানা আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিও জাতীয়করণ করেছি। এসব জাতীয়করণের অর্থ আমাদের বুঝে দেখতে হবে। এগুলি সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পদ। শ্রমিকেরা সারা জীবন শিল্প কারখানা, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছেন। এগুলি জাতীয়করণের অর্থ হলো শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দেওয়া। আমরা শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে সমস্ত কল-কারখানা ছিল তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, কারখানা চালাতে এ গভর্নমেন্টের একশো আটান্ন কোটি টাকা দিতে হয়েছে।যদি কারখানা চালিয়ে উৎপাদন না করতে পারেন, আমি বেতন বাড়াবো কোথা থেকে? আপনারা আমার কাছে চান নাই। আমার কাছে। দাবি করার দরকারও নাই। আমি আপনাদের জন্য জীবনভর দাবি করেছি। আমার কাছে আপনারা কী দাবি করবেন? আপনারা না বললেও আমি ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। তাতে ৩৫ কোটি টাকা বেতন বাড়াতে হয়েছে। আপনারা যদি উৎপাদন না করেন, আমি টাকা দেব কোথা থেকে? আমি কি তবে বাংলাদেশটা বিক্রি করে টাকা দেব? না, বাংলাদেশকে বিক্রি করতে পারবো না। আমাকে সমালোচনা করে বলা হয়েছে- আমি ধর্মঘট কেন বন্ধ করলাম? কিন্তু আমি তো ধর্মঘট বন্ধ করতে চাই নাই। তবে, আমি যদি শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য টঙ্গীতে টাকা পাঠাই বা রিলিফের টাকা দিই আর সেখানে সেই টাকা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তারপর আবার যদি কেউ বেতন নিতে আসে তাহলে সেটা কি ভালো হয়? শ্রমিকদের কর্তব্য হলো উৎপাদন করা।
ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন
আমি এখানে আজ আর একটা কথা ঘোষণা করছি। সরকার যেসব কারখানা জাতীয়করণ করেছেন, এখন থেকে সেগুলির প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে দুইজন করে সদস্য থাকবেন এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বোর্ডে পাঠাবেন। এছাড়া বোর্ডে সরকারের এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনজন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যা-ই আয় হোক না কেন; আদমজী, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না। কোথায় যাবে, তা আপনারা জানতে পারবেন৷ আপনারা হলেন শতকরা একজন বা দেড়জন, আর বাংলার কৃষক হলো শতকরা ৮৫ জন। আয়ের একটা অংশ আপনারা নেবেন। আর বাকি অংশ দেশের কৃষকদের। তাদের টাকা দিয়ে শিল্প কারখানা চালানো হয়। তাদের ভোগ করার অধিকার রয়েছে। শ্রমিক ভায়েরা, দুধ খান; গরু জবাই করে খেয়ে ফেলবেন না। তাতে দেশ চলবে না।
আর লাল বাহিনীর ভায়েরা, আপনারা হবেন আদর্শ কর্মী। আপনাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। আর আপনাদের দেখাতে হবে যে, ৮ঘণ্টার জায়গায় লাল বাহিনীর ছেলেরা ১০ ঘণ্টা পরিশ্রম করে। এবং এই কাজ দেখিয়ে অন্য শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হবে। আপনারা ১০ ঘণ্টা না পারেন ৯ ঘণ্টা কাজ করুন বা ৮ ঘণ্টা করুন। উৎপাদন বাড়ান। তাহলেই লাল বাহিনী আপনাদের ইজ্জত থাকবে। লাল টুপি মাথায় দিয়ে বেড়ালে লাল বাহিনীর ইজ্জত পাওয়া যাবে না।
সমাজবিরোধী কার্যকলাপ
ভায়েরা আমার, আজ আপনাদের বেতন বাড়ালেই সুবিধা হবে না। সেই জন্য বাংলাদেশে ৪,২০০ দোকান খোলা হচ্ছে প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে ন্যায্য মূল্যে জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য। শ্রমিক এলাকায়ও এ ধরনের দোকান খোলা হবে। তাতে খরচ হবে ১৯ কোটি টাকা। তবে মজুদদার, চোরাকারবারী আর চোরাচালানীরা হুঁশিয়ার হয়ে যাও। তাদের আমি সোজা কথায় বলে দিচ্ছি, পাঁচ মাস আমি তাদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, বুঝিয়েছি, অনেক করে বলেছি- এ কাজ করো না। আমার বিশ্বাস ছিল যে, তারা আমার কথা শুনবে। কিন্তু দেখছি, চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনি’। তাই তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছ, যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছ, যারা মজুদ করছ, জিনিসপত্র বিক্রয় করছ না, জিনিসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছ, তাদের রেহাই নাই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরিব-দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুটপাট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নাই। আমি ১৫ দিন সময় দিলাম। ১৫ দিনের মধ্যে যদি সরকারি বাড়ি না ছাড়ো, যদি মজুদ করে রাখো, এক একটা এলাকায় আমি কারফিউ দেব আর সমস্ত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট আর আমার স্বেচ্ছাসেবকরা সেখানে তল্লাশি চালাবেন। আমি কিছু বলি নাই। এখন বলে দিলাম, হুকুম দিয়ে দিলাম। এর পরেও এতদিন বড় বড় বক্তৃতা করবে আর রাত্রি বেলায় চোরা গাড়িতে চড়বে; এটা হবে। না। আমার প্রাণ থাকতে নয়। বার বার ঘুঘু তুমি ধান খেয়ে যাও। আর ঘুঘু ধান খাওয়ার চেষ্টা করো না। আমি পেটের মধ্য হতে ধান বের করে ফেলবো। চিন্তার কারণ নাই ।
এমসিএ–দের সমালোচনা
ভায়েরা আমার, আর একটা কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। আওয়ামী লীগ ২৩ বৎসর এই বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। এখন কিছু লোক এই আওয়ামী লীগের এমসিএ-দের নিন্দা করে। কিন্তু ২৩ জন এমসিএ-কে বহিষ্কার করেছে কোন পার্টি? এমন বহিষ্কারের নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশের ইতিহাসে আছে? কিন্তু আমি বহিষ্কার করেছি, আওয়ামী লীগ করেছে। ভবিষ্যতে যদি কোনো এমসিএ বা পার্টি— সে যে পার্টিরই হোক না কেন, কিংবা কোনো শ্রমিক নেতা বা ছাত্রনেতা চুরি করে তাহলে আমি মাফ করবো না।
এখন এমসিএ-দের সমালোচনা করার অর্থ কী? যারা সমালোচনা করেন, তাঁরা ভাবেন, আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো। তাঁরা যদি এমসিএ দের দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন, তাহলে নিজেরা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করবেন। কিন্তু সব এমসিএ-ই কি চোর? কোনো এমসিএ কি যুদ্ধ করেন নাই? তারা কি গুলি খেয়ে মরে নাই? এমসিএ-দের মধ্যে ভালো মানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে। সব দলেই ভালো-মন্দ মানুষ আছে। যারা খারাপ, তারা সব সময়ই খারাপ। আমার দলের মধ্যে কেউ যদি চুরি করে; বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়, আমি জানি। তাঁর পরিষদ সদস্যপদ আমি কেড়ে নেব। কিন্তু এমসিএদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা খারাপ। তাঁরা গণ-পরিষদের সদস্য। তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, তাঁরা শাসনতন্ত্র তৈরি করবেন। আমি বাংলাদেশে শাসনতন্ত্র দিতে চাই, ইয়াহিয়া খান বা আইয়ুব খানের মতো গভর্নমেন্ট চালাতে চাই না। জনগণকে আমি ভয় করি না। জনগণকে আমি ভালোবাসি। সে জন্য শাসনতন্ত্র যত শীঘ্র হয় আমি দেব।
জাতির আদর্শ
এখন আমাদের একটা শ্লোগান। আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪টা স্তম্ভ। আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি- এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ।
দ্বিতীয় স্তম্ভ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র।
এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র। তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধন-সম্পদ বাড়াতে দেব না। বাংলার কৃষক, মজদুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।
কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে, সে দেশে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি জনগণকে ভালোবাসি, আমি জনগণকে ভয় পাই না। দরকার হলে আবার ভোটে যাবো। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।
চতুর্থত, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ।
পাকিস্তানে আটক বাঙালি
আর একটা কথা বলি। ভুট্টো সাহেব নারাজ হয়ে গেছেন তিনি আবোল তাবোল বকছেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুলি-বিকুলি করছেন। আমি বলেছি, বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিন। তারপর এসব বিবেচনা করে দেখবো। তিনি এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছেন। তিনি একটু ভয় পেয়ে গেছেন নাকি? যারা আমার মা-বোনের ওপর অত্যাচার করেছে, যারা পশুর মতো আমার জনসাধারণকে হত্যা করেছে, যারা নিরপরাধ কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করলে নাকি তিনি বড় অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব, শুনে রাখুন। তাদের বিচার বাংলার বুকে অবশ্যই হবে।
ভুট্টো সাহেব আমার চার লক্ষ বাঙালিকে আটকে রেখেছেন। তারা নিরপরাধ, কিছুই করে নাই। তবু তিনি দর কষাকষি করছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি আমার বাঙালিদের ইনশাল্লাহ্ বাংলার বুকে ফেরত আনবো। তিনি ঠেকাতে পারবেন না।
তবে, একটা অনুরোধ করবো আপনাদের কাছে। যে সমস্ত অবাঙালি এখানে আছে, যারা আলবদর, রাজাকার নয়; যারা বাংলার মাটিতে বাঙালি। হিসেবে বাস করতে চায়, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, তাদের বাংলায় থাকবার অধিকার রয়েছে। যারা যেতে চায়, ভুট্টো সাহেব যেন মেহেরবানী করে তাদের নিয়ে যান। আমার আপত্তি নাই। তিনি বলছেন, তিনি তাদের নেবেন না। কেন নেবেন না? তাদের হাতে তো বন্দুক তাঁরাই দিয়েছিলেন। তাঁদের তো ব্যবহার করেছিলেন। তাদের দিয়ে বাঙালিদের হত্যা করিয়েছিলেন। এখন কেন নেবেন না? যারা যেতে চায়, তাদের নিয়ে যান। আমি ছেড়ে দেব। আমার চার লক্ষ লোক ফেরত দিন। ভুট্টো সাহেব যেন এ কথা মনে না করেন যে, বাংলাদেশে শুধু বিহারি আছে। পশ্চিম পাকিস্তানেরও অনেকে আমার কাছে আছে। ভুট্টো সাহেব আমার লোক ফেরত দিন, আমিও তাদের লোক ফেরত দিচ্ছি। যুদ্ধাবন্দীর সঙ্গে জনসাধারণ কোনোদিন এক হতে পারে না। এমন নজির দুনিয়ায় নাই,
কোনোদিন হয় নাই। একদল লোক দুনিয়ায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিহারিরা বড় কষ্টে আছে। যখন আমার লোক না খেয়ে মরছিল, যখন গুলি খেয়ে মরছিল, যখন এ দেশের মানুষকে ধরে ধরে কুর্মিটোলায় গুলি করেছিল, যখন জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন কেন মেহেরবানী করে তাঁরা প্রতিবাদ করেন নাই? এখন কেন তারা কেঁদেকেটে একবারে অস্থির হয়ে পড়ছেন?
ত্রাণ ও বিদেশি সাহায্য
আমার বাংলার এক কোটি লোক পশ্চিম বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে ছ’মাসে ফিরে এসেছে। তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের খাবার দিতে হয়। আমার বাংলাদেশের দেড় কোটি লোক এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, ও গ্রাম থেকে এ গ্রামে পালিয়ে বেড়াত। তাদের জন্য কেউ মায়াকান্না কাঁদে নাই। গ্রামে যান। দেখে আসুন, আমার মানুষ না খেয়ে আছে। আমার মানুষের কাপড় নাই। আমার কৃষকের বীজ নাই। আমার মানুষের চাল নাই ।
আমি তো পরিষ্কার বলেছি, দুনিয়ার সমস্ত দেশ থেকে আমি সাহায্য নিতে রাজি আছি, কিন্তু সে সাহায্য হবে শর্তহীন। শর্ত দিয়ে কারো কাছ থেকে আমি ভিক্ষা আনতে পারবো না। শর্ত ছাড়া যদি কেউ আমাকে সাহায্য করতে চায়, দুনিয়ার যে কোনো দেশ থেকে সাহায্য নিতে আমি রাজি আছি। তবে এমন কিছু আনতে চাই না, যাতে ভবিষ্যতে আমার অসুবিধা হতে পারে। সে জন্য আমি একটু আস্তে আস্তে চলি।
শিল্পের উৎপাদন
শ্রমিক ভায়েরা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটু উৎপাদন করো। আল্লাহর ওয়াস্তে মিল খেয়ে ফেলো না। পয়সা থাকবে না। ব্যাংক থেকে ১৫৭ কোটি টাকা তোমাদের আমি দিয়েছি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাবার জন্য। অনেক মিল বন্ধ। তবু মাইনে দিয়ে চলছি। অনেক মিলে অর্ধেক কাজ হয়। সেখানেও আমি মাইনে দিয়ে চলছি। আমি তাদের ভালোবাসি, এই জন্যই তো আমি বিনা কথায় ২৫ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ২/৩ বৎসর কষ্ট করতে হবে। উৎপাদন করতে হবে। ইনশাআল্লাহ একবার যদি উৎপাদন বেড়ে যায়, তাহলে আর কোনো কষ্ট হবে না। শ্রমিকরা সমস্ত মানুষের সঙ্গে সমানভাবে দেশের সম্পদ ভাগ করে খেতে পারবে। কিন্তু চার সের দুধ হলে তারা এক সের খাবে। বাকি তিন সের গ্রামের লোককে দেবে। চার সেরই যেন নিজেরা না খায়। তাহলে গ্রামের লোেক বাঁচবে না। গ্রামে থাকে কারা? আপনার আমার বাবা-মা। যারা গ্রামে বাস করে, তারাই কৃষক। তাদের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে। তাদের আমি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত খাজনা মাফ করেছি। তাদের আমি ঋণ দিচ্ছি। দরকার হলে আরো দেব। আমি চাই, তারা খাদ্য উৎপাদন করুক। আমি বেশি দিন ভিক্ষা করতে পারবো না। আমার ৩০ লক্ষ টন খাদ্যের দরকার। ১৭ লক্ষ টন আমি পেয়েছি। আর ১০ লক্ষ টন ইন্শাআল্লাহ আমি পাব। খাদ্য সামগ্রীর অভাব হবে না।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার একটু কমের দিকে গেছে। আমাদের অনেক খবরের কাগজ, যেগুলি দাম বাড়তে দেখলে লাফ দিয়ে কেবল বাড়ায়। যখন কমে তখন আর মেহেরবানী করে কিছু লেখে না। তারা যেন দাম কমলে একটু লেখে। আমার তো ছোট চাদরের অবস্থা। মাথায় দিলে পা খালি, পায়ে দিলে বুক খালি। চাল আনলে ডাল আসে না, ডাল আনলে নুন আসে না। নুন আনলে তেল আসে না, তেল থাকলে লবণ থাকে না। আনতে হয় চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে, চালনা পোর্ট থেকে।
ভায়েরা আমার, আমি জানতে চাই– আপনাদের আমার উপর আস্থা আছে, কি নাই? আওয়ামী লীগের উপর আস্থা আছে, কি নাই?
বাংলাদেশকে গড়বেন, কি গড়বেন না? তিন বছর আমি কিছু দিতে পারবো না। দাবি-দাওয়া আমার কাছে চলবে না একদল লোক বলছে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে ফেলে বেহেস্তে গেলেও শান্তি পাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে সুখী করতে চায়। বাংলাকে সোনার বাংলা করতে চায়। লোকে বলে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। মুজিবুর রহমান সব ছেড়ে দিচ্ছে । কিন্তু আমি কেন সব ছাড়বো?
আজ মুনাফাখোর, আড়তদার, চোরাকারবারী- সাবধান হয়ে যাও ভবিষ্যতে যদি জিনিসের দাম আর বাড়ে, আমি তোমাদের শেষ করে দেব কারফিউ করে করে। আর দরকার যদি হয়, আইন পাস করবো। যদি চোরাকারবারী বা আড়তদাররা আমার কথা না শোনে, তাদের ছাড়বো না। আর যারা অস্ত্র নিয়ে চলে, তারা সোজা পথে না এলে আমি বাধ্য হয়ে আইন পাস করবো তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোররা নয় নম্বর ধারায় চাকরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, গুণ্ডা, বদমাইশ, ডাকাত, সাবধান হয়ে যাও ।কর্মী ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে তোমরা পাহারা দাও, যাতে চোর গুণ্ডা বদমাইশ মানুষের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করতে না পারে।
আর যারা শুধু সমালোচনা করে বক্তৃতা করে, তাদের কাছে অনুরোধ করি, গ্রামে গিয়ে একটু কাজ করুন, একটু রিলিফের কাজ করুন তাতে ফল হবে। আমি এবার তাহলে চলি। খোদা হাফেজ।
জয় বাংলা।
নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাই। বঙ্গবন্ধু