আত্মসমালোচনা আত্মসংযম আত্মশুদ্ধি চাই : বঙ্গবন্ধু

।। জগেশ রায় ।।
শুক্রবার, ২৭ মে, ২০২২

১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর উদ্বোধনী ভাষণ

 

সহকর্মী ভাই ও বোনেরা, বিদেশ থেকে স্বাগত অতিথিবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগের কর্মী ভায়েরা,

আপনারা আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এবারই নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্য হিসেবে প্রথম আপনারা সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কর্মী ভায়েরা, আওয়ামী লীগের ইতিহাস আপনারা জানেন- হাসি-কান্নার ইতিহাস, রক্তের ইতিহাস, অত্যাচারের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, জয়ের ইতিহাস। আপনাদের সঙ্গে বাংলার মাঠ-প্রান্তরে, গ্রামে গ্রামে আমি কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম থেকে প্রথমে আমি যোগদান করি যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে। তিপ্পান্ন সাল থেকে পঁয়ষট্টি সাল পর্যন্ত কাজ করি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং ছেষট্টি সাল থেকে এ পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে। গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হলে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, সম্পাদক কিংবা কর্মকর্তা হওয়া যায় না। তবুও গতবার আপনারা আমাকে কিছুদিনের জন্য দায়িত্বভার দিয়েছিলেন আপনাদের সভাপতি হিসেবে কাজ করার জন্য। আজ আপনাদের নতুন করে প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে।

ফাঁকির স্বাধীনতা,

আপনারা জানেন, কীভাবে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম। দুইশো বছর ইংরেজ এ দেশকে শাসন করে। দুইশো বছর পরে ১৯৪৭ সালে এক ফাকির স্বাধীনতা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। আমরা; বাংলাদেশের জনগণ সংখ্যাগুরু ছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষকে শোষণের পর শোষণ করার জন্য সামরিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত পাকিস্তানের। সংখ্যালঘু শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে নতুন করে বাংলাকে পরাধীন করে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কলোনীতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গড়ে তোলে তাদের দেশকে। কিন্তু বাংলার মানুষ চুপ করে থাকে না।

এ সব শাসন-শোষণ ও সংগ্রামের অনেক ইতিহাস আপনাদের জানা আছে। কারণ, অনেক আন্দোলনের মধ্য থেকে আপনাদের জন্ম। অনেক রক্ত দিয়ে আপনাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। আপনাদের বার বার মোকাবেলা করতে হয়েছে শোষক শ্রেণিকে। মোকাবেলা করতে হয়েছে একদল মীরজাফরকে। বাংলাদেশের একদল শোষক যদি হাতে হাত না মিলাত তাহলে পঁচিশ বছর পাকিস্তানিরা বাংলাকে শোষণ করতে পারত না। যতবার আমরা সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছি ততবারই এই বাংলার মাটিতে একদল লোক সেই শোষকদের হাতিয়ার হিসেবে আমাদের উপর চড়াও হয়েছে। বার বার আমরা এদের মোকাবেলা করেছি। বার বার আমরা মার খেয়েছি। অবশেষে আমরাও চরম আঘাত হেনেছি, যে আঘাতে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

সহকর্মী ভায়েরা ও বোনেরা, ১৯৪৭ সালের পূর্বে আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা স্বাধীন হবো। কিন্তু ‘৪.৭ সালেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমরা নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছি। এর মধ্য থেকেই আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। জনগণ তখন বুঝতে পারে নাই। শোষক গোষ্ঠীর নায়করা এখানে শক্তিশালী সরকার গঠন করে। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে। এই অবস্থায়ও আমরা কিছুসংখ্যক দেশপ্রেমিক তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করি।

আমার মনে আছে, ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম আমরা ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। উদ্দেশ্য। শোষকগোষ্ঠীর মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু আমরা এগুতে পারলাম না। অনেক সময় থিওরি ও প্র্যাকটিসে গণ্ডগোল হয়ে যায়। থিওরি খুব ভালো। কাগজে-কলমে লেখা থিওরি অনেক মূল্যবান। পড়ে শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল কাজের সঙ্গে মিল না থাকলে থিওরি কাগজে-কলমে পড়ে থাকে; কাজে পরিণত হয় না।

তখনকার দিনে একদল লোক এ ধরনের থিওরির অনুসারী ছিল। এ সময় ভারতবর্ষে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন রণদিভে। তিনি পি সি যোশীকে তাড়িয়ে দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি বললেন, এখনই অস্ত্রের সাহায্যে মোকাবেলা করা দরকার। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তারা এদিক-ওদিক আঘাত হানলেন। আমাদের এখানেও কিছুসংখ্যক কর্মী বুঝতে না পেরে সেই পন্থা অবলম্বন করতে গেলেন। আমাদের সঙ্গে তাঁদের মতের অমিল হলো। আমরা বললাম, দেশের মানুষকে না গড়ে তুলে, দেশের মানুষকে মোবিলাইজ না করে এবং পরিষ্কার আদর্শ না নিয়ে চলা যায় না। তারা বুঝতে পারলেন না। ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ ভেঙে গেল।

ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের জন্ম

সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন শোষণ করতে চায় তখন তারা আঘাত করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর, ভাষার উপর। তাকে ধ্বংস করতে না পারলে শোষণ করা সহজ হয়ে উঠে না। তাই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানল। সংখ্যাগুরু লোকের ভাষার উপর আঘাত করে আমাদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হলো। তখন একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল মুসলিম লীগ। জিন্নাহ সাহেব তখনও বেঁচে আছেন এবং তাঁর দলের লোকেরাই বাংলাদেশের শাসন চালিয়েছিল। তাদের শক্তি ছিল, সামর্থ্য ছিল, অর্থ ছিল। বিদেশি শক্তিও তাদের পিছনে ছিল। আমরা ভাষার উপর এ আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১১ মার্চ তারিখে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন শুরু করি। ঐ তারিখেই অন্যান্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে আমরা শোষকগোষ্ঠীর আঘাতের মোকাবেলা করি।

আজ মনে পড়ে আমার বন্ধু ও সহকর্মী শামসুল হকের কথা, যার সঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। তিনি আর ইহজগতে নাই। তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার কথা যদি আজ আমি স্মরণ না করি, অন্যায় করা হবে। মরহুম শামসুল হক আর আমি একসঙ্গে গ্রেফতার হই। তারপরেই আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। আমরা বুঝতে পারলাম, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে। তা না হলে আন্দোলন। করা যাবে না। তাই আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। আমাদের সহকর্মীদের মোবিলাইজ করতে শুরু করলাম।

আবার আমাকে গ্রেফতার করা হলো। আমার সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হলো। আমরা সেখানে একটি রাজনৈকি প্রতিষ্ঠান করবো বলে ঠিক করলাম। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে আমি যখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী, তখন আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায়ই তারা আমাকে যুগ্ম-সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেন।

বায়ান্ন সালের আন্দোলন

অনেকে ইতিহাস ভুল করে থাকেন। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আপনাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার উপর ও আমার দেশের উপর যে আঘাত হয়েছে, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মোকাবিলা করতে হবে। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়। এ কথা আজ বলতে পারি; কারণ আজ পুলিশ কর্মচারীর চাকরি যাবে না। সরকারি কর্মচারীর চাকরি যাবে না। কথা হয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করব, আর ২১ তারিখে আন্দোলন শুরু হবে। জেলে দেখা হয় বরিশালের মহিউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে। তাকে বললাম, আমরা এই প্রোগ্রাম নিয়েছি। তিনি বললেন, আমিও অনশন ধর্মঘট করবো। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। এর দরুন আমাদের ট্রান্সফার করা হলো ফরিদপুর জেলে। সূচনা হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।

তারা চরম আঘাত করল ভাষার উপর, কৃষ্টির উপর। চরম আঘাত হানল আমাদের উপর। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগের কণ্ঠ রোধ করে দেয়া হলো। আওয়ামী লীগের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হলো। আওয়ামী লীগ কর্মীদের পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এভাবেই আমাদের দিন কাটতে থাকে। এ অবস্থায় আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাই। একদিনে সংগ্রাম হয় না। একদিনে দেশ জয় হয় না। একদিনে আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। এজন্য চাই নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।

সহকর্মী ভাইয়েরা, আজ এসব কথা কেন বলছি? এ জন্য বলছি যে, এতকাল পর্যন্ত আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি কাজ চালিয়েছি। আজ আমার বিদায় নেয়ার পালা। আজ আমি আপনাদের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারি না। আজ আপনাদের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। কারণ আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এটাই আমার সভাপতির শেষ ভাষণ। এই জন্যই আপনাদের কাছে আমার কিছু বলা দরকার। এ জন্যই আজ সংক্ষেপে আওয়ামী লীগের কিছু ইতিহাস বলছি। এই প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করলেই বক্তৃতা আমি দেবার পারি না। কত চেহারা ভেসে উঠে আমার সামনে! কত ত্যাগী কর্মী কারাবরণ করেছে। কত ভাই, কত সহকর্মী শহিদ হয়েছে। এদের সঙ্গে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছি। কত দিন আন্দোলন করতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। তাদের কথা আমি স্মরণ না করলে অন্যায় করা হবে। কারণ আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তারা আমাদের মধ্যে নাই।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চরম আঘাত আসে আওয়ামী লীগের উপর। শোষকগোষ্ঠী আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির উপর হামলা চালায়। অত্যাচার চালায় বাংলার মানুষের উপর। কিন্তু আমরাও বসে থাকি নাই। বাংলার জনগণ, বাংলার ছাত্র সমাজ, বাংলার যুব সমাজ, বাংলার প্রগতিশীল কর্মীরা এই হামলার মোকাবেলা করতে থাকে বার বার। কিন্তু অপর পক্ষ ছিল বড় শক্তিশালী। তাদের হাতে ছিল অস্ত্র, মেশিনগান। তাদের কাছে ছিল অর্থ, ছিল ধোঁকাবাজি। তারা বিশেষ অস্ত্র হিসেবে। ব্যবহার করত ধর্মের নাম। আমার বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাই ধর্মের নামে ধোকা দেয়া যত সহজ অন্য কিছুতে ততটা সহজ নয়। তাই ধর্মকে তারা ব্যবহার করল বাংলার মানুষকে শোষণ করার অস্ত্র হিসেবে।

শোষকের নয়া ষড়যন্ত্র

১৯৫২ সালের আন্দোলনের পরে শোষকগোষ্ঠী দেখল যে, বাংলা ভাষাকে এভাবে দাবানো যাবে না। তাই তারা ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি ও সভ্যতাকে এবং আমাদের আন্দোলনকে বানচালের চেষ্টা করতে আরম্ভ করে।

ভাই ও বোনেরা, ১৯৫৪ সালের ইতিহাস আপনারা জানেন। আমরা বায়ান্ন সালে জেল থেকে বের হয়ে আসি। তিপ্পান্ন সালেও আমাদের অনেক কর্মী গ্রেফতার হয়। ১৯৫৪ সালে একটা নির্বাচন দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেই যুক্তফ্রন্ট। বাংলার মানুষ একতাবদ্ধ হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন চিফ মিনিস্টার হন। কিন্তু পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী আঁৎকে উঠে। তারা বাংলার মানুষকে একতাবদ্ধ হতে দেবে না। তাই আবার তারা আঘাত হানার চেষ্টা করে।

যেদিন আমি মন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলার কেবিনেটে শপথ নিয়েছি, সেদিনের কথা আমার মনে আছে। ঠিক সেই সময় এক ঘণ্টার মধ্যে আদমজীতে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করা হলো। তারা ষড়যন্ত্র করল এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তাই সৃষ্টি করল তাদের দালালদের দিয়ে এই দাঙ্গা। মানুষের জন্য তাদের কোনো দরদ ছিল না। মানুষকে তারা ভালোবাসত না। ক্ষমতাকেই তারা বড় করে দেখত। তাই ‘৫৪ সালে তারা দাঙ্গা বাধাল আদমজীর পাটকলে। আমার মনে আছে, পাঁচশোরও বেশি লোক সেখানে মারা যায়। শপথ নিয়েই সেখানে আমরা দৌড়ে যাই। উপস্থিত হই ৷ মোকাবিলা করি। মানুষকে বুঝাবার চেষ্টা করি।১৯৫১ সালেও তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে বাংলার মাটিতে। এতে এদেশের অনেক নিরীহ লোক জীবন দেয়। এই দাঙ্গা তারা সৃষ্টি করে বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করার জন্য। কারণ, বাংলাদেশে যদি বিভেদ সৃষ্টি করা না যায় তাহলে তারা শাসন ও শোষণ চালাতে পারবে না। এমনি করে তারা চালায় তাদের ষড়যন্ত্র। আমার মনে আছে তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদের ৫০ জনের মতো সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের কয়েক হাজার কর্মী গ্রেফতার হয়। বাংলার মানুষের উপরে অত্যাচারের স্টিম রোলার চলে। কিন্তু আমরা নিরুৎসাহ হই নাই। আমরা আরও সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম আরম্ভ করার চেষ্টা করি। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আওয়ামী লীগের পরিষ্কার আদর্শ আমাদের সামনে ছিল। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ছিল। তাদের কর্মী ছিল, তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি স্তম্ভ

সহকর্মী ভায়েরা, আমাদের রাষ্ট্রের চারটি আদর্শ আছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির তেমনি চারটি স্তম্ভ থাকা প্রয়োজন। এই চারটি স্তম্ভ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আমি গর্বিত যে ২৫ বছরে আওয়ামী লীগ সেই স্তম্ভগুলি প্রতিষ্ঠিত করেছে। ২৫ বছরের আওয়ামী লীগ কর্মীদের জন্য আমি গর্বিত। বার বার জনগণের সাহায্য ও সমর্থনের জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বের। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। নেতারা চেষ্টা করেছেন সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। নেতৃত্বের সঙ্গে প্রয়োজন আদর্শের। যাকে অপর কথায় বলা যায় ম্যানিফেস্টো। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য কী আদর্শ কী— এটা থাকতেই হবে। নেতৃত্ব ও আদর্শের পরে প্রয়োজন নিঃস্বার্থ কর্মীর নিঃস্বার্থ কর্মী ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বড় হতে পারে না, কোনো সংগ্রাম সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না। এর পরে প্রয়োজন সংগঠনের সংগঠন ছাড়াও কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাজ সফল হতে পারে না।

সেই জন্য বলছিলাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি জিনিসের প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে নেতৃত্ব, ম্যানিফেস্টো বা আদর্শ নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন।আমি আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগের ১৯৪৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নেতৃত্ব ছিল, আদর্শ ছিল, নিঃস্বার্থ কর্মী ছিল এবং সংগঠন ছিল। এই ভিত্তির উপরই সংগ্রামে এগিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছে।

আইয়ুবের সামরিক শাসন

১৯৫৪ সালের পর অনেক ইতিহাস। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাই। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তারপর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চলে। কিন্তু শোষকগোষ্ঠী দেখল যে, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তাই ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন।

বাংলাদেশ আরও বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়ে। কারণ সামরিক বাহিনীর শতকরা ৯৫ জন ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা বাংলাদেশেরও সরকার দখল করল। মার্শাল ল’ জারি করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে শোষণ করা। আমরা গ্রেফতার হলাম। সহকর্মীরা গ্রেফতার হলো। আওয়ামী লীগ পার্টি ব্যান্ড হলো। আওয়ামী লীগ কর্মীরা গ্রেফতার হলো। তাদের বিরুদ্ধে বহু মিথ্যা মামলা জারি করা হলো। কিন্তু তারা চুপ করে বসে রইল না। ব্যান্ড হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের কাজ চলল।

আমরা সংখ্যাগুরু। তারা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বন্দুকের জোরে বাংলার মানুষের উপর মিলিটারি শাসন আরম্ভ করল। দুশো বছরে ইংরেজ যা করে নাই, ২৫ বছরে পাকিস্তানিরা বাংলার মাটিতে তাই করল। সম্পদ অর্থ যা কিছু সেখানে জড়ো করল। সেখানে রাজধানী, সেখানে সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টার, ইনভেস্টমেন্টের হেডকোয়ার্টার, অ্যাসেম্বলী সব কিছু প্রতিষ্ঠিত হলো।

১৫শো মাইল দূরের দুটি অংশ নিয়ে কোনো সময় কোনো একটি রাষ্ট্র হয়েছে বলে আমার জানা নাই। কিন্তু আমরা ধর্মভীরু মানুষ তাই পাকিস্তানিরা ধর্মের নামে এক রাষ্ট্রের দোহাই দিতে আরম্ভ করল। আমরা যারা ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম তারা সংগ্রাম করেছি। যারা বুঝতে চেষ্টা করে নাই। তারা তাদের দালালি করেছে।

বাষট্টি সালের আন্দোলন

১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হন। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগ পার্টি তখন ব্যান্ড। অন্যান্য পার্টিও ব্যান্ড ছিল। আমরা জেল থেকে চেষ্টা করলাম কী করে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যায়। আমরা আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখলাম । আওয়ামী লীগ কর্মীরা যে যেখানে ছিল বিপদের সম্মুখীন হয়েও নীতি পরিবর্তন না করে, আদর্শ পরিবর্তন না করে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।

আমরা চিন্তা করে দেখলাম এদের সঙ্গে আর আমাদের চলবে না। যেখানে আদর্শের মিল নাই, যেখানে মতের মিল নাই, যেখানে ভাষার মিল নাই, যেখানে চিন্তার মিল নাই, সেখানে এক রাষ্ট্র চলতে পারে না ! আজ কোথায় পাকিস্তান, কোথায় বাংলাদেশ! ১৫শো মাইলের ব্যবধানে তার সঙ্গে আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নাই। এক রাষ্ট্র করা হয়েছিল বাংলাদেশকে শোষণ করবার জন্য, কলোনী করার জন্য। তারা সাড়ে সাত কোটি লোকের বাংলাদেশকে তাদের শিল্প পণ্যের বাজারে পরিণত করে। তাদের কল-কারখানার শিল্প দ্রব্য বাংলাদেশে বিক্রয় করে এখানকার অর্থ সম্পদ লুটে নেয়। আমাদের কিছু কিছু লোক ছিল তারা মন্ত্রী হলেও খুশি হতেন, পার্লামেন্টের সদস্য হলে খুশি হতেন, সামান্য ব্যবসায়ী হলে খুশি হতেন। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা তারা চিন্তা করতেন না।

আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন

১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ইন্তেকাল করলেন। আওয়ামী লীগকে আমরা রিভাইভ করলাম। আবার আমরা আওয়ামী লীগকে অর্গানাইজ করার উদ্যোগী হলাম। এই সময় কিছু কিছু লোক আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে চলে গেল। ভালোই হলো। আবর্জনা যতই যায় ততই মঙ্গল। কয়েকবারই এরকম হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি হয় না।যাদের আদর্শ নাই, যাদের নীতি নাই, যারা দুর্নীতিবাজ, যারা দেশকে ভালোবাসে না; তারা যদি প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যায়, তাতে প্রতিষ্ঠান। দুর্বল হয় না। প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়। তাই ভবিষ্যতেও এ ধরনের লোকদের প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের আরো শক্তিশালী করতে হতে পারে।

পরিষ্কার রাস্তা : ৬ দফা

ভায়েরা ও বোনেরা, আমরা আমাদের সহকর্মীদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট পথে যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর অনেক ভাঙা-গড়া হলো। ১৯৬৬ সালে আমার দেশবাসী জানতে চায়— পরিষ্কার রাস্তা কোথায়? বাঙালি চায় কী? তাদের সামনে কী আছে? তখন ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুল নামে একটা পদার্থ ছিল। ফান্ডামেন্টাল রাইটস ছিল না। আইয়ুবী শাসন চলছিল তখন বাংলার মাটিতে। অত্যাচারের স্টিম রোলার চলছিল বাংলার মাটিতে— আমাদের চোখের সামনে। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম— পরিষ্কার পন্থা দিতে হবে। বাংলার মানুষকে আর আমরা এভাবে শোষিত হতে দিতে পারি না। মানুষের একদিন মরতে হয়। আমরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছি। দরকার হলে আরো অত্যাচার সহ্য করবো। কিন্তু পরিষ্কার রাস্তা দেখাতে হবে। ওদের সঙ্গে আমরা থাকতে পারি না। আমার বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে হবে। বাংলার অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে থেকে বাংলার মানুষ তা কোনো দিন করতে পারবে না। এর উপায় কী?

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে চাই— যারা মনে করেন, রাতের অন্ধকারে গুলি করে কিংবা একটা রেললাইন তুলে দিয়ে টেরোরিজম করে বিপ্লব হয়— তারা কোথায় আছেন, তারা জানেন না। এই পন্থা বহু পুরানো পন্থা। এই পন্থা দুনিয়ার কোনোদিন কোনো কাজে লাগে নাই। এ পন্থা দিয়ে দেশের মানুষের কোনো মঙ্গল করা যায় না। একটা রাস্তা ভেঙে দিয়ে ও একজন লোককে অন্ধকারে হত্যা করে শুধু শুধু মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়। এই টেরোরিজম দিয়ে দেশের বিপ্লব হয় না, হয় নাই, হতে পারে না।জনগণকে ছাড়া, জনগণকে সংঘবদ্ধ না করে, জনগণকে আন্দোলনমুখী না করে এবং পরিষ্কার আদর্শ সামনে না রেখে কোনো রকম গণআন্দোলন হতে পারে না। এবং সেখানে কোনো বিপ্লব হতে পারে না। দুঃখের বিষয়, অনেকে এখনও টেরোরিজম-এ বিশ্বাস করেন। যাই হোক, ভবিষ্যতে তাদের ভুল ভাঙবে। সময় থাকতে না ভাঙলে তাদের ক্ষতি বেশি হবে। জনগণের ক্ষতি তো হবেই, কিন্তু তাদেরও ক্ষতি হবে।

পরিষ্কার রাস্তা হিসেবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়া হলো। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করবেন বলে হুমকি দিলেন। আইয়ুব খান বোকা ছিলেন না। আইয়ুব খান বুঝতে পারলেন– ৬ দফা আওয়ামী লীগ কেন দিয়েছে? এর পিছনে উদ্দেশ্য কী? পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছে, এর উদ্দেশ্য কী? এবং আমরা জানতাম আমাদের উদ্দেশ্য কী ও কোথায় আমরা যাবার চাই; কী আমরা বোঝাতে চাই।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

৬-দফা বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ। আমরা মুক্তি সনদ কেন দিলাম, আইয়ুব খান বুঝতে পারলেন। তাই তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করলেন আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর কিছু বাঙালি ছেলে, বাঙালি সরকারি কর্মচারী ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। তারা আমাদের কারাগারে বন্দী করলেন। আওয়ামী লীগকে ব্যান্ড করলেন না, কিন্তু তারা বন্দী করলেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে। আওয়ামী লীগ ভাঙার জন্য পাকিস্তান থেকে কিছু নেতা এসে তখন চেষ্টা করলেন। ভাঙলেন কিছুটা। কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতা বুঝতে না পেরে যোগদান করলেন তাদের সাথে। আমি তখন কারাগারে বন্দী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন, মনসুর আলী, শামসুল হক, জালাল, জহুর ও চিটাগাং-এর আজিজসহ আমাদের বহু সহকর্মীও বন্দী হয়। যারা বাইরে রইল, তারা ৬ দফাকে আঁকড়ে ধরল। তারা মোকাবেলা করল, নেতৃত্ব দিল। নজরুল ছিলেন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট, এই অবস্থায় তারা শুরু করল। শাসকরা পারল না আওয়ামী লীগকে দাবাতে ।গণঅভ্যুত্থান

বাংলার ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়াল এর বিরুদ্ধে। গণআন্দোলন শুরু হলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য সব প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠান ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করল। তারা আওয়ামী লীগকে সক্রিয় সমর্থন দিল এবং তাদের সঙ্গে যোগদান করল। আইয়ুব খানের আসন নড়ে উঠল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উইথড্র হয়ে গেল। আমরা খালাস পেলাম।

আবার একটা ফন্দি করা হলো। রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স। রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের উদ্দেশ্য ছিল একটা কনস্টিটিউশন প্রবলেম সলভ করা। আমি আমার সহকর্মী ছাড়াও কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গেলাম আমার সঙ্গে। কারণ আমাদের বুঝতে হবে, এটা রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স না; ধোঁকা। আসলে এটা ছিল বাংলাকে শোষণ করার আরেকটা ষড়যন্ত্র। তাই আপনাদের পক্ষ থেকে আমি তা রিজেক্ট করলাম। বলে দিলাম, সংগ্রাম করে বাংলার মানুষ তাদের দাবি আদায় করবে। রাউন্ড টেবিলে বসে নয়।

ইয়াহিয়ার আবির্ভাব

আইয়ুব খান বিদায় নিলেন। ইয়াহিয়া খানকে বসিয়ে দেয়া হলো। প্রেসিডেন্ট হয়ে বসে পড়লেন আর এক জেনারেল সাহেব। তিনি বললেন, নির্বাচন দিবেন। নির্বাচন দেওয়া হলো। আমাদের অনেকে বুঝতে পারলেন না। তারা বড় বড় বক্তৃতা করলেন। প্রশ্ন করলেন— কেন আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি? বাংলার মানুষ যে একতাবদ্ধ, এক; বাংলার মানুষ যে বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ যে মুক্তি চায়, তার জন্য আমাদের নির্বাচনে যাওয়া প্রয়োজন– তারা এ কথা বুঝতে পারেন নাই। বুঝতে পারেন নাই, শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য কী?

আমরা নির্বাচনে গেলাম। আমরা ১৬৯টি সিটের মধ্যে ১৬৭টি সিট ক্যাপচার করলাম। দুনিয়া দেখল– বাংলার মানুষ একতাবদ্ধ। এই প্রথম একতাবদ্ধ। বাংলার মানুষের মধ্যে কনফিডেন্স ফিরে আসল। ইয়াহিয়া খান আঁৎকে উঠলেন। শোষকগোষ্ঠী আঁৎকে উঠল। তারা আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হলো। আমরা জনগণকে আন্দোলনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলাম।আমরা শপথ গ্রহণ করলাম যে, নীতির সঙ্গে কোনো আপোস নাই। জনগণ যে ম্যান্ডেট দিয়েছে, তা থেকে আমরা সরতে পারি না।

তারপরের ইতিহাস চরম ইতিহাস। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে আন্দোলন করতে হয়েছে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেকে বক্তৃতা করে; বড় বড় তেজি বক্তৃতা। কিন্তু তারা জানে না ১৯৪৭-৪৮ সাল কী ছিল। ১৯৫০, ‘৫২, ‘৫৪ সাল কী ছিল। ওরা জানে না ১৯৫৭-৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৫-৬৬, ১৯৬৮-৬৯ ও ‘৭০ সাল কী ছিল। ওদের কারো কারো সে দিন জন্ম হয় নাই। অনেকে আন্দোলন দেখে নাই। আন্দোলন কাকে বলে জানে না। কোনো দিন জীবনে জেলের দরজা দেখে নাই। অবিচারের সামনে পড়ে নাই। আন্দোলন গাছের ফল নয়। আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। আন্দোলনের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী থাকতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।

অসহযোগ আন্দোলন

তারা ভুলে যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের ইতিহাস ভুলে যায়। কী ভাবে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এককভাবে এদেশে নন-কোঅপারেশন মুভমেন্ট করে। ছাত্র-জনতা, ধর্ম শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে তাতে যোগদান করেছিল। দেশের মানুষ সংঘবদ্ধ ছিল, শোষকগোষ্ঠী আঁৎকে উঠেছিল। শোষকরা জানত এবং আমরাও জানতাম যে, আওয়ামী লীগ তাদের দাবি থেকে এক চুলও নড়বে না। কারণ আওয়ামী লীগ কোনোদিন ওয়াদা ভঙ্গ করে নাই। তারা ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে না। বাংলার মানুষ যা বলেছে তাই হবে। এর পিছনে সরার ক্ষমতা আমাদের নাই। তাই আমি সেদিন বলেছিলাম— ৬-দফা জনগণের সম্পদ। আওয়ামী লীগের আর শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পদ নয়। ওটার সঙ্গে আপোস হয় না। অনেকে গোপনে আপোসের প্রপাগাণ্ডা করতেন। কিন্তু আমরা জানতাম যে ইয়াহিয়া খান সৈন্য সমাবেশ করছেন।আজ সকলের জানা দরকার, আমরাও বসে ছিলাম না। আমরা যদি বসে থাকতাম; একই সময় একই মুহূর্তে বাংলাদেশের ৫৮টা মহকুমায় সশস্ত্র বিপ্লব শুরু হতো না। রেসিস্ট্যান্ট মুভমেন্ট শুরু হতো না। শুরু হয়েছিল এজন্য যে, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিচ্ছিল। ২৫ মার্চ তারিখে আমি যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম, আমি যখন

বাংলার মানুষকে ডাক দিলাম, তখন আমি গ্রেফতার হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার সহকর্মীরা আমার অনুপস্থিতিতেও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংগ্রাম উপরের থেকে পড়ে নাই। নজরুল তখন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট আমাকে করে। তাজউদ্দীন প্রাইম মিনিস্টার হয়েছিল। তারা দেশের এই সংগ্রাম চালায়। অবশ্য আমাদের সহযোগী দু-একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আমাদের সমর্থন দিয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টি দিয়েছিল। আমাদের মোজাফ্ফর ন্যাপও দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন প্রতিষ্ঠান ছিল কার? নেতৃত্ব ছিল কার? আজ যারা বড় বড় কথা বলে, কোথায় ছিল তারা? কোথা থেকে তারা এসেছে? কে তাদের কথা শুনত?

প্রতিরোধ সংগ্রাম

আজকে তারা সংগ্রাম করে গভর্নমেন্ট গঠন করতে চায়। ২৫ মার্চ তারিখে কার উপরে আক্রমণ শুরু হয়? আক্রমণ শুরু হয় আওয়ামী লীগের উপরে, আওয়ামী লীগের কর্মীদের উপরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপরে, রাজারবাগে আমার পুলিশের উপরে, আমার সামরিক বাহিনীর বাঙালি ছেলেদের উপরে, আর আমার বিডিআর-এর উপরে। এরপর রেসিস্ট্যান্স মুভমেন্ট আরম্ভ হয়। অ্যারোপ্লেন, জাহাজ না থাকলে তারা কিছুই করতে পারত না। আমাদের অস্ত্র ছিল না। সামান্য যা জোগাড় করতে পেরেছিলাম সেগুলো সমস্ত জায়গায় বাংলাদেশের মহকুমায় মহকুমায় পাঠানো হয়েছিল। প্রত্যেক মহকুমায় মহকুমায় আমাদের কমান্ডার ঠিক করা ছিল। প্রত্যেক জিলায় জিলায় আমাদের কমান্ডার ঠিক করা ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন একদিনে হয় নাই। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়েছে ২৫ বছর আগে থেকে। আওয়ামী লীগের জন্ম, সংগ্রামের জন্ম। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের আজ যদি মৃত্যু হয় তবে আমি দেখতে চাই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেন মৃত্যু হয়।কর্মী ভায়েরা, আজ তোমাদের সামনে আমার অনেক কথা বলার আছে। কত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক শহিদ হয়েছে বাংলার স্বাধীনতার জন্য! লক্ষ লক্ষ মা-বোনের আর্তনাদ আজও মোছে নাই, আজও থামে নাই । আজও তাদের চোখের পানি যায় নাই। সেই সংগ্রামে আওয়ামী লীগের এমন কোনো কর্মী নাই যার বাড়িঘর জ্বালাইয়ে দেওয়া হয় নাই। গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগারদের বাড়ি কোনটা, আওয়ামী লীগের কর্মীর বাড়ি কোনটা, আওয়ামী লীগের বাপ-মা কে, সেইগুলো বেছে বেছে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধরতে পারলে এক মুহূর্ত দেরি করে নাই, গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।

স্বাধীনতার ঘোষণা

বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ যুবক, লক্ষ লক্ষ কৃষক, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক রক্ত দিয়েছে। আর কারো কথায় নয়; শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকেই তারা জীবন দিয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস কোনোদিন মিথ্যা করতে নাই। আমার সহকর্মীরা যারা এখানে ছিল তারা সকলে জানত যে ২৫ তারিখ রাত্রে কী ঘটবে। তাদের বলেছিলাম, আমি মরি আর বাঁচি, সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো। বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ৭ মার্চ কি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল । সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম সহকর্মী ভায়েরা, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আপনারা জানেন, আমি আর বলতে চাই না। ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কী করেছে, আপনারা জানেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাস্তা-ঘাটের অবস্থা, পোর্টের অবস্থা সবই আপনারা জানেন।

১০ জানুয়ারি তারিখে আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আজ আমি বেঁচে আছি, অথচ আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। এ দু’বছর আমার লাইফের এক্সটেনশন হলো। ৫৭ বছর চাকরি হয়ে গেলে সরকারি চাকরি যেমন এক্সটেনশন হয়; তেমনি আমার লাইফেরও এক্সটেনশন হয়েছে। কিন্তু কয় বছর এক্সটেনশন হয়েছে, তা আমার জানা নাই। কারণ ওটা খোদার হাতে। তবে দুই বছর পার হয়েছে- বলতে পারি। আমার সহকর্মীদের দশা হয়েছিল তাই। ধরা পড়লে আর এক্সটেনশন হতো না, সঙ্গে সঙ্গে শেষ ।

অর্থনৈতিক মুক্তি

তাই আজকে ভেবে দেখুন, যে আদর্শের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন সে আদর্শ কী? কেন স্বাধীনতা সংগ্রাম করলাম? কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিল? আজ সত্যিই আমরা স্বাধীন। আজ আমার পতাকা ওড়ে। আজ আমার জাতীয় সংগীত বাজে। দুনিয়ার ১১৬টি দেশ আমাদের রিকগনিশন দিয়েছে। আজ আমার কৃষ্টি ও ভাষার উপর কেউ আঘাত করতে পারবে না। আজ বাংলার মাটি আমার, আমি বাংলার মাটির। আজ বিদেশি শোষকরা আমার দেশকে শোষণ করতে পারবে না। আজ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বাংলার মাটিতে স্থান পাবে না। আজ আমরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে দিব না। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এটা একদিক। আর একদিক রয়েছে। সহকর্মী ভায়েরা মনে রেখো কোনোদিন আমি আমার কথা না বুঝে বলি না। আমি জেনেশুনেই বলেছিলাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। কিন্তু মানুষ মুক্তি পাবে সেই দিন, যেই দিন অর্থনৈতিক মুক্তি দেবা বাংলার মানুষকে। তোমরা এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছো, দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু করেছো। আওয়ামী লীগের সহকর্মীরা, এইখানেই তোমাদের পরীক্ষা— অগ্নিপরীক্ষা।

ভারতের বন্ধুত্ব

আজ আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ভারতবর্ষের কথা স্মরণ করি। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী পাঁচ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে বাংলার মাটিতে থাকতে পারে নাই৷ এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার সহকর্মীরা আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনগণ এবং শ্রীমতী গান্ধী ও তাঁর সরকার বাংলার মানুষকে যদি সেই দিন আশ্রয় না দিত, যদি সান্ত্বনা না দিত; বাংলার মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকত না। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর লোকেরা আমার দেশের মানুষকে শেষ করে দিত। তাই আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের স্মরণ করি কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, এ বন্ধুত্ব এমনি আসে নাই। দুর্দিনে যে লোক আমার পাশে দাঁড়ায়, সে-ই হলো আমার সত্যিকারের বন্ধু। তাই ভারতবর্ষ আমার বন্ধু। আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ, ভারত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করবো না। আমার ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের ভিত্তিতে আমি বাস করতে চাই। আজ আমি স্মরণ করি আমার সহকর্মী ভাইদের কথা, আমার বাংলার জনগণের কথা যে জনগণ রক্ত দিয়ে গেছে। স্মরণ করি আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের কথা— যারা রক্ত দিয়েছে, যারা শহিদ হয়েছে, যারা আজ পঙ্গু হয়ে আছে। আমি স্মরণ করি সেই মা-বোনদের কথা, যাদের উপর অত্যাচার হয়েছে, সেই সঙ্গে আমি নিশ্চয়ই স্মরণ করি ভারতের সেই সমস্ত সেনাবাহিনীর জোয়ানদের কথা, ১৪ হাজার জোয়ান, যারা বাংলার মাটিতে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচিয়েছিল ।

স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে

ছেলে- খেলা নয়। রাষ্ট্র চালানো এত সোজা নয়। আওয়ামী লীগ কর্মী ভায়েরা, আমি আগেই বলেছি, আজ স্বাধীনতা সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। এখন আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে। যে জনগণ সংঘবদ্ধভাবে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সেই জনগণ কিন্তু আজও আছে। যদি আজ জনগণ আপনাদের অশ্রদ্ধা করে, যদি আজ জনগণ আপনাদের ভালো না বাসে, জনগণ যদি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে, জনগণ যদি আপনাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, সেই জন্য বাংলার জনগণ দায়ী হবে না- দায়ী হবেন আপনারা, দায়ী হব আমরা। আপনারা জানতেন না— কোনোদিন আপনারা ক্ষমতায় আসবেন। আওয়ামী লীগ সহকর্মীরা, আপনারা জানতেন না- এত সহজে কোনোদিন আপনারা যুদ্ধে জয়লাভ করবেন। এত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পাবেন। আপনারা আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। এ স্বাধীনতাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।কিন্তু স্বাধীনতা পেলেও বিদেশি দালালরা আজ চুপ করে বসে নাই। এ স্বাধীনতাকে তারা আজ সহজে গ্রহণ করতে পারে নাই। সেই জন্যই তারা ছলে-বলে- কৌশলে কাজ করছে। সম্মুখ সমরে না যেয়ে পিছনের রাস্তা অবলম্বন করেছে। পিছনের পথ দিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। মাত্র দু’বছর আগে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, তাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে।

চারটি রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ

আমি বিশ্বাস রাখি, আওয়ামী লীগ কর্মীদের জীবন থাকতে এ স্বাধীনতা কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। সহকর্মী ভায়েরা, আজ আপনাদের সামনে যথেষ্ট কাজ রয়েছে। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। আজ আমাদের নীতি পরিষ্কার। আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে চারটা স্তম্ভ রয়েছে। এটার মধ্যে কোনো কিন্তু নেই। এটা পরিষ্কারভাবে শাসনতন্ত্রে দেওয়া হয়েছে। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। আওয়ামী লীগ পার্টি বিশ্বাস করে—আওয়ামী সংগ্রাম করেছে, তাই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে যে নীতি ছিল, তা আজ রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। এটা রক্ষা করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ কর্মীদের সবচেয়ে বেশি। যে বিশ্বাস করবে না, তার জন্য রাস্তা খোলা আছে। আমাদের নীতি পছন্দ না হয় চলে যেতে পারেন। থাকলে নীতি বিশ্বাস করে থাকতে হবে। মানুষ মরতে পারে— নীতি, আদর্শ মরে না কোনোদিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের পরে আপনারা শাসনতন্ত্র দিয়েছেন। আপনারা নির্বাচন দিয়েছেন। বাংলার মানুষ শতকরা ৯৭টি সিট আপনাদের দিয়েছে। এদেশ শাসন করার অধিকার আপনাদের আছে।

আত্মসমালোচনা আত্মসংযম আত্মশুদ্ধি

কিন্তু দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম,আত্মসমালোচনা কর। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মত্মসংযম কর, আর আত্মশুদ্ধি কর। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা।

আওয়ামী লীগ কর্মী ভায়েরা, কোনোদিন তোমরা আমার কথা ফেলো নাই জীবনে আমি কোনোদিন কন্টেস্ট করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বা প্রেসিডেন্ট হই নাই। জীবনভরই তোমরা আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছো। তোমরা আমার কথায় রক্ত দিয়েছো, আজ শেষ দিন– কেননা, আমি সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি তোমরা আমার কথা মনে রেখো। আমার কথা ভুলো না কোনো দিন স্বার্থে অন্ধ হয়ে তোমাদের ডাক দেই নাই। কোনো দিন কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে কোনো শয়তানের কাছে মাথা নত করি নাই। কোনো দিন ফাঁসির কাষ্ঠে বসেও বাংলার মানুষের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা আমার কথা শুনবা, তোমরা আত্মসমালোচনা করে, আত্মসংযম কর। তোমরা আত্মশুদ্ধি কর। দুই চারটা-পাঁচটা লোক অন্যায় করে, যার জন্য এত বড় প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ কর্মী জীবন দিয়েছে, যে প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর পর্যন্ত ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছে; তার বদনাম হতে দেওয়া চলে না।

আজ বাংলার নিভৃত কোণে আমার এক কর্মী পড়ে আছে, যার জামা নাই, কাপড় নাই। তারা আমার কাছে আসে না। আপনাদের অনেকেই এখানে আছেন। কিন্তু আমি যদি চরকুকরী-মুক্রী যাই, আমার ঐ ধরনের কর্মীকে আজও দেখি। আমি যদি কক্সবাজারে যাই, আমার গ্রামের একটা কর্মীকে দেখি। এদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্বন্ধ আজও আমি দেখি তার পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। আজও দেখি, সেই ছেঁড়া পায়জামা, ছেঁড়া শার্ট, পায়ে জুতা নাই। বাংলাদেশে আমার এ ধরনের লক্ষ লক্ষ কর্মী পড়ে আছে। কিন্তু কিছু কিছু লোক যখন মধু মক্ষিকার গন্ধ পায় তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায় আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা কর।

আওয়ামী লীগ কর্মীরা, আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে। দিতে হবে। আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই। তাই বলছি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে। তোমরা, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলাররা আজ যারা এখানে বসেছ তারা মনে মনে চিন্তা করো। বুকে হাত দিয়ে খোদার উপর নির্ভর কইরা বল যে, আমরা মানুষকে ভালোবাসি। আমরা বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমরা ২৫ বছর সংগ্রাম করেছি। আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আমরা ইতিহাস রাখবো। আমরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবো। আমরা দেশকে মুক্ত করবো। তাহলেই আওয়ামী লীগের ইতিহাস থাকবে। তাহলে মরেও আমি শান্তি পাব। তা না হলে আমার বড় দুঃখ, বড় কষ্ট।

সহকর্মী ভায়েরা, বোনেরা; নীতি ছাড়া, আদর্শ ছাড়া এবং যে কথা আমি বলেছিলাম আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি ছাড়া তা হয় না। ন্যায়-নীতি ও আদর্শ সামনে রাখতে হবে। সে আদর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

শত্রু মোনাফেক

ভুলে যেয়ো না। স্বাধীনতা পেয়েছো এক রকমের শত্রুর সাথে ফাইট করে। তখন আমরা জানতাম, আমাদের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু এখন শত্রুকে চেনা বড় কষ্টকর। আমি একদিন গল্প করতে গিয়ে বলেছিলাম, জীবনে আমি তিনটা জিনিসকে ভয় পাই। আর কাউকে আমি ভয় পাই না। একটা হলো কুমীর। নদীতে থাকে। পানির মধ্যে গোসল করতে গেলে পা ধরে টান দিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না। দ্বিতীয়টা সাপ, ফুস করে মেরে দিলে যুদ্ধ করতে পারি না। আর তৃতীয়টা মোনাফেক। তার সঙ্গেও সামনাসামনি যুদ্ধ করা যায় না। কুমীর, সাপ আর মোনাফেক! তোমরা আগে যুদ্ধ করেছ। কিন্তু এখন বাংলার মাটিতে এদের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করার উপায় নাই ।তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে মোনাফেক, তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে কেউটে সাপ আর পানির তলে কুমার। এরা রাতের অন্ধকারে গুলি করে মারে, আর বলে রাজনীতি করে। রাত্রে একজন লোক শুয়ে আছে, তাকে জানালা দিয়ে গুলি করে মারল। বলে আমি বিপ্লবী । তুমি বিপ্লবী, না দাগী চোর? যে কোনো সময় যে কোনো মানুষকে গুলি করে মারা যায়। এটা কি বিপ্লব? তোমরা রাত্রে গুলি করে মারো, আমরা প্রস্তাব পাস করি। আর আমি যদি লোকদের বলে দিই যে, তোমরাও রাত্রে গুলি করে মারো, তখন কী হবে? এদের কোনো নীতি নাই, এদের কোনো আদর্শ নাই, এদের কিছুই নাই। এরা বড় বড় কথা বলে। আসলে চোর-ডাকাতের ন্যায় হাট-বাজারে ডাকাতি করে জিন্দাবাদ দিয়ে চলে যায়। সব ডাকাত, সব চোর। হাট-বাজার, চিনির দোকান, মুরগির দোকানে, সবজির দোকানে ডাকাতি করে বিপ্লব হয় না। ঐ রণদিভের থিওরি ইট মারো, সেপাইর আস্তানায় ইট মারো, ওয়ালে একটা পাথর মারো। এতে বিপ্লব হয় না।

সেই জন্যই আমি বলতে চাই যে, তাকে বিপ্লব বলে না। তাকে বলে পার্ভার্সান— বিপ্লবের বিকৃতি। এই যত বিপ্লবীরা সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিরা আমার পাশে বসে আছেন, বহু বিপ্লব করছেন, এরা ফাউন্ডার্স অব দি বিপ্লব (বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা)। সেটা এদের কাছে থেকে জেনে নাও। জনগণকে ছাড়া, গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না। রাতের অন্ধকারে গুলি মাইরা কোনো দিন বিপ্লব হয় নাই। পড় সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের ইতিহাস, পড় অন্যান্য দেশের বিপ্লবের ইতিহাস। পড় আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। দেখ, সেখানে কী হয়েছে। দেখ আমাদের এই সাব-কন্টিনেন্টে কী হয়েছে। পড়, জান, শেখ বোঝ। তারপরে বিপ্লবের কথা বল। বিপ্লব রাতের অন্ধকারে গুলি কইরা, টেরোরিজম কইরা হয় না। আবার এখন একটা সুবিধা হয়েছে, রাত্রের অন্ধকারে গুলি করে মাইরা বলে– আমরা মাওবাদী। কিন্তু আমি জানি, তোমরা চোর আর গুণ্ডা ছাড়া আর কিছু না।

তাই আপনাদের কাছে আমি বলতেছিলাম যে, আপনাদের চারটা আদর্শ— যেটা রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ— সেটা প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে।গণতন্ত্র, না সন্ত্রাস

একদল লোক গণতান্ত্রিক পন্থাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছি। পাঁচ বৎসর পর নির্বাচন কর। যদি নির্বাচনে তোমরা কেউ আসতে পার, যে কোনো দল মেহেরবানী করে চলে আস। আওয়ামী লীগ গদি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু তোমরা জানো, যে যতই বক্তৃতা কর, আর মানুষ যতই বক্তৃতা শুনুক না কেন, ভোট দেবার সময় তোমাদের অবস্থা যা আছে— আগেও যা হয়েছে পরেও তাই হবে। সে জন্যই তোমরা জনগণের উপর আস্থা রাখ না। একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকারকে ব্যবহার করবো; আর অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে আওয়ামী লীগ কর্মীকে মারবো, প্রগতিশীল কর্মীকে মারবো, আর বলবো— অস্ত্র নিয়ে মোকাবেলা করবো; বলবো, অস্ত্র নিয়ে বিপ্লব করবো। কোনো স্বাধীন দেশ , কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা অ্যালাউ করা যায় না। বহু সহ্য করা হয়েছে। দুই বৎসর সহ্য করা হয়েছে। বলা হয়— বঙ্গবন্ধু কঠোর হও। বঙ্গবন্ধু কঠোর কি-না আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, নসরুল্লাহ খান, লিয়াকত আলী খান সবাই জানেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেয়েছিল কী? বাংলার মানুষ তাকে জাতির পিতা করেছে। বাংলার মানুষ তাকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। বাংলার মানুষকে আমি বুঝবার চেষ্টা করেছি। তাদের বলতে চেষ্টা করেছি, তোমরা কাজ কর। তোমরা গণতন্ত্রের পথ অবলম্বন কর। দু’টো খেলার অধিকার তোমাদের নাই। গণতান্ত্রিক অধিকারও তোমরা ব্যবহার করবা আর বিপ্লবের কথা বলে রাতের অন্ধকারে গুলি মারবা, অস্ত্র ফেরত দেবা না, সে অধিকার তোমাদের নাই, সে অধিকার তোমাদের দেওয়া হবে না। এটা মনে রাখা দরকার, সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া হয়েছে। জনগণ দেখতে চাও জনগণ দেখবা। কয়েক হাজার লোক মিটিং-এ যোগদান করলেই মনে করো না যে হয়েছে। এখনও আওয়ামী লীগ ডাক দিলে রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোক এসে হাজির হবে।

মনে করো না যেন বড় একটা কিছু হয়ে গেছে। সাবধান হয়ে যাও। এক দল বলে, অমুক তারিখ থেকে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু কর। তারপরেও আমি কিছু বলি না। তবুও তারা বলে কি যে, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে হাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু তোমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নাই, থাকতে পারে না। নইলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা অন্ধকারে মরে? আওয়ামী লীগ কর্মী এবং প্রগতিশীল কর্মী, যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে আমি তাদের কাছে অস্ত্র চেয়েছিলাম। তারা অস্ত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু তোমরা গোপনে কিছু কিছু অস্ত্র রেখে দিয়েছো এবং সেগুলি গোপনে ব্যবহার করছো। আজ যদি আওয়ামী লীগ কর্মী বা প্রগতিশীল কর্মীর কাছে একদিন অস্ত্র দিয়ে দেয়া হয় তাহলে একজনের অস্তিত্বও বাংলাদেশে থাকবে না। আমাকে বাধ্য করো না। দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করো না, যাও গণতন্ত্রের অধিকার আছে বক্তৃতা কর। বাই-ইলেকশন হবে, ইলেকশনে নামো ইউনিয়ন কাউন্সিল ইলেকশনে জিততে পারে না রাত্রিবেলা এসে চেয়ারম্যানকে গুলি করে মারে। কয়— কী করলাম? বিপ্লব করলাম। কী বিপ্লব? চেয়ারম্যান মারছে। বাবা, এ তো শুনি নাই। আমার মনে হয়, এখানে যত দেশের লোকেরা আছেন, যদি শোনেন সবাই হাসবেন। কারণ তাহলে বিপ্লবের ইতিহাস বদলিয়ে লিখতে হবে।

কর্মীদের কর্তব্য

আজ সেইজন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের কাছে আমার কথা যে, তোমাদের কর্তব্য রয়েছে। স্বাধীনতা এনেছো। এবার খোদাকে হাজের নাজের রেখে এই প্রতিজ্ঞা করে যেতে হবে যে, বাংলার মানুষকে সুখী করতে হবে। আমার বাংলার দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। শোষণহীন সমাজ করতে হবে। যে রাষ্ট্রীয় চার আদর্শ আছে তাকে পরিপূর্ণ করতে হবে। এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। তাহলেই তোমাদের আদর্শ পূর্ণ হবে, এর আগে নয়।

তোমাদের সে জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। তোমাদের আরো ত্যাগের প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করে, তারা জীবনভর করে। তোমরা ত্যাগ করছো। আরও করবা। আর যারা মজা মারে তারা এমনিও মারে অমনিও মারে। সেজন্য তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ আছে– কর্মীরা তোমাদের কাছে আমার দাবি আছে। তোমরা জীবনে আমার চোখের সামনে কোনোদিন কথা বল নাই। যা বলেছি, তোমরা তাই করেছ। তোমরা হাসতে হাসতে মৃত্যুমুখে দাড়িয়েছ। তোমরা পারবা না আমার কথা শুনতে? দুর্নীতি আমরা দেখব না, দুর্নীতি আমরা করব না, দুর্নীতি এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবো। তোমরা পারবা না এ দেশের মানুষকে ভালোবাসবার? আমরা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবো। এ দেশের মানুষ শান্তিতে। ঘুমাতে চায়, আমরা শাস্তি দেবো। পারবা না তোমরা এ কাজ করতে। বল আমার কাছে। না পার আমাকে বিদায় দিয়ে দাও। আমি কিছু চাই না তোমাদের কাছ থেকে।

সহকর্মী ভাইয়েরা, আমি বলে দিচ্ছি, আমি সেন্টিমেন্টালি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে অ্যাটাচড়। কথাটা তোমাদের পরিষ্কার বলে দেবার চাই। তোমরা সকলে জানো যে, প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য আমি রাজনীতি করি নাই। তোমরা জানতা, ইচ্ছা করলে আমি বহু আগে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। এ প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে কাঁটা বলে মনে হয়। আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তা হলে আমি শান্তিতে মরতে পারবো না— পারবো না- পারবো না। আমার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। আমার যৌবন কারাগারের অন্তরালে কাটিয়ে দিয়েছি এ দেশের মানুষের জন্য৷ আমি ওদের কাছে থাকতে চাই, ওদের কাছে থাকতে চাই, ওদের সঙ্গে মরতে চাই— এর বেশি আমি আর কিছু চাই না।

গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র

তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, তোমরাই শুধু পার আমার অনুরোধ রাখতে। কারণ তোমরা আমার বহু দুর্দিনের কর্মী। ১৯৪৯ সাল থেকে তোমরা এ পর্যন্ত আপদ-বিপদ, মুসিবত, অত্যাচার, অবিচার, জুলুম, গুলি সব অগ্রাহ্য করে আমার পাশে দাঁড়িয়েছ বাংলার মানুষকে স্বাধীন করার জন্য। স্বাধীন তোমরা করেছো। এবার বাংলার মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। দিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তি, সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সমাজতন্ত্র ছাড়া রাস্তা নাই। শোষণহীন সমাজ গাছ থেকে পড়ে না। শোষণহীন সমাজ বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক গড়তে হলে আমার কর্মী ভাইদের সমাজতন্ত্রের কর্মী হতে হবে। ক্যাডার তৈরি করতে হবে, ট্রেনিং দিতে হবে। না হলে পারব না কিছু করতে।

তোমাদের নিঃস্বার্থ কর্মী হয়ে ট্রেনিং নিতে হবে। সমাজতন্ত্রে আমরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে যাবার চাই। এবং আমরা দুনিয়াকে দেখাতে চাই যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন সিস্টেমে আমরা শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলবো।

আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই– আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো। বাংলার কৃষ্টি বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ তোমাদের মনে রাখতে হবে।

সমাজতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা

আর একটা জিনিস। রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ। তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন, তাঁরা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামীন— রাব্বুল মুসলেমীন নন। হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক— সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান। সেই জন্যই এক মুখে সোস্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আর এক মুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আর একটা হচ্ছে পশ্চিম। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেয়ো। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছো। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলাাার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে। তোমাদের মনে রাখা দরকার, সেজন্য আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার। আমাদের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে কোনো কিন্তু নাই। সে সমাজতন্ত্র হলো আমার অর্থনীতি। একে গড়তে হলে কর্মীদের সমাজতান্ত্রিক কর্মী হতে হবে, ক্যাডার হতে হবে, ট্রেনিং নিতে হবে। তাহলেই আমরা সফল হবো। অবশ্য অনেক লোক আছে যারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে

পারে নাই। তারা পিছন থেকে কিছু ঢেলা মারার চেষ্টা করছে। যারা প্রগতির নামে সাম্প্রদায়িকতা করছে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। গ্রামে গ্রামে দেশের মানুষকে সংঘবদ্ধ করে বোঝাতে হবে– একেই বলে সমাজতন্ত্র, একেই বলে শোষণহীন সমাজ; একেই বলে সুষম বণ্টন। তাহলে বাংলার মানুষ তোমাদের পিছনে থাকবে।

পররাষ্ট্রনীতি

সহকর্মী ভাই ও বোনেরা, আওয়ামী লীগ পার্টি দীর্ঘদিন ধরে যে বৈদেশিক নীতি দিয়েছে, আমার মনে হয় আপনাদের এই সরকার সেই নীতি পুরোপুরি পালন করতে চেষ্টা করেছে। ভারতবর্ষ, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোশ্লাভিয়া ও অন্যান্য যেসব দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের সাহায্য করেছে, আজ তাদের কথা স্মরণ করি। এ ছাড়াও ঐ সমস্ত দেশের কথা স্মরণ করি, যারা বিপ্লবের পরেও আমাদের ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনর্গঠনে সাহায্য করেছেন। আমাদের সাহায্য করেছেন ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, জিডিআর, ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রি এবং আরো বিভিন্ন দেশ। সাহায্য করেছেন সমস্ত সোস্যালিস্ট কান্ট্রি। তাদের সঙ্গে আমাদের রিলেশন ভালো হয়েছে।

আমরা আজ গর্বিত যে, মধ্যপ্রাচ্যে আমরা আরব ভাইদের এবং প্যালেস্টাইনবাসীদের পাশে রয়েছি। ইসরাইলিরা তাদের ন্যায্য অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। ইসরাইলিরা জাতিসংঘের প্রস্তাব মানে নাই। তারা দখল করে বসে আছে আরবদের জমি। আরব ভাইদের এ কথা বলে দেবার চাই এবং তারা প্রমাণ পেয়েছে যে, বাংলার মানুষ তাদের পিছনে রয়েছে, আরব ভাইদের নায্য দাবির পক্ষে রয়েছে। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করবো।যেসব দেশ আমাদের সাহায্য দিয়েছে, আমি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। শান্তিপূর্ণ দেশ সহঅবস্থানে বিশ্বাস করে। আমি বিশ্বাস করি নন-অ্যালাইড, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেন পলিসি। আমরা কারুর পকেটে যাবার চাই না। আমরা সকলের বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় একটা দেশ পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে বিশ্বাসী নয়।

আত্মসম্মানের বিনিময়ে বন্ধুত্ব নয়

যে চীন নিজেকে মহান দেশ বলে এবং দুঃখী মানুষের বন্ধু বলে গর্ব করে, সে চীন সম্পর্কে আমার একটা কথা বলার আছে। চীনের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু আত্মসম্মান বিক্রি করে আমরা কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই না। আমরা এমন কিছু করি নাই যেজন্য চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দিতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চীন বাংলার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে। আমরা সে জন্য দুঃখিত। তবুও চীন অনেক বড় দেশ, আমরা তাদের বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু চীন একটা সাম্রাজ্যবাদী ও ক্যাপিটালিস্ট দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। আর বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ যারা রক্ত দিয়ে বিপ্লব করে দেশকে স্বাধীন করেছে, তারা যাতে জাতিসংঘে স্থান না পায়, সে জন্য চীন জাতিসংঘে ভেটো দিল বাংলার বিরুদ্ধে।

ইতিহাস বড় তাৎপর্যপূর্ণ। যখন চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দেয়া হতো, তখন এই বাংলার মানুষই বিক্ষোভ করত। আমি নিজে ঐ ভেটোর বিরুদ্ধে বহুবার কথা বলেছি, যে ভেটোর জন্য চীন ২৫ বৎসর জাতিসংঘে যেতে পারে নাই। দুঃখের বিষয়, সেই চীন আজ ভেটো “পাওয়ার” হয়ে প্রথম ভেটো দিল আমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবুও আমি কামনা করি তাদের বন্ধুত্ব। অনেক বড় দেশ। দুশমনি করতে চাই না। বন্ধুত্ব কামনা করি। কারণ আমি সকলের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু জানি না, আমার এই কামনায়, আমার এই প্রার্থনায় তাঁরা সাড়া দেবেন কি-না। যদি না দেন কিছু আসে যায় না। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা এত ছোট দেশ নই।বাংলাদেশ এতটুকু নয়। পপুলেশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র ।

আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এসেছি। এ স্বাধীনতা আমরা আলোচনা করে বা রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স করে আনি নাই। সেজন্য আজ আমাদের পরিষ্কার কথা— আফ্রিকা হোক, ল্যাটিন আমেরিকা হোক, আরব দেশ হোক; যেখানে মানুষ শোষিত, যেখানে মানুষ অত্যাচারিত, যেখানে মানুষ দুঃখী, যেখানে মানুষ সাম্রাজ্যবাদীর দ্বারা নির্যাতিত; আমরা বাংলার মানুষ সেই দুঃখী মানুষের সাথে আছি এবং থাকবো। আমাদের নীতি পরিবর্তন হবে না। আওয়ামী লীগের নেতারা, এটা নিশ্চয়ই আপনাদেরও নীতি আমাদের সরকারের তরফ থেকে এটা পালন করা হচ্ছে।

আর্থিক অবস্থা

আজ আমাদের দেশের আর্থিক অবস্থা বড়ই খারাপ। অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি ভালো নয়। কেন? ২৫ বছর শোষণ করে সব নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিনা পয়সায়, বিনা বৈদেশিক মুদ্রায় সরকার চালাতে হচ্ছে। সাড়ে সাত কোটি লোকের দেশ । সবকিছু বিধ্বস্ত। একে গড়া এত সোজা নয়। তাছাড়া দুনিয়াতে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মতো যারা উন্নয়নশীল দেশ, যারা দেশকে গড়ে তুলতে চায়, তারা মহাবিপদের সম্মুখীন।

আমাদের কষ্ট হবে। তবুও একটা কথা মনে রাখা দরকার, যে সাহায্য আমি চাই, আওয়ামী লীগ যে সাহায্য চায় তা আত্মসম্মান বিক্রি করে নয়। আওয়ামী লীগ সরকার সেই সাহায্য গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। আমাদের কেউ যদি কিনতে চান, ভুল হবে। কেউ যদি সাহায্যের নামে আমাদের দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তবে ভুল হবে। আমরা শোষিত মানুষ। বহু ত্যাগ করেছি। বহু রক্ত দিয়েছি। দরকার হয় আরও দেবো। কিন্তু আত্মসম্মান বিক্রি করে আমরা কারো কাছে সাহায্য চাই না। যারা বন্ধু হিসেবে সাহায্য করতে চান তারা আমার ভাই। আসুন, আমরা সাহায্য নিশ্চয়ই গ্রহণ করবো। কারণ দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার দেশকে গড়তে হবে।

দুর্নীতি

আজ সত্য কথা বলতে কি আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার— আওয়ামী লীগ কর্মীরা, কোথায় যেন গোড়ায় একটু গলদ রয়ে গেছে। মানুষ এত অর্থের জন্য পাগল হয়েছে কেন? শুধু টাকা কামাই করবে কী করে, এই চেষ্টা। একদিন হাসতে হাসতে বললাম যে, বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষ এরা কিন্তু অসৎ নয়। ব্ল্যাকমার্কেটিং করে কারা? রাগ করবেন না। আপনারা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আছেন, আপনারা রাগ করবেন না। ব্ল্যাকমার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্ল্যাকমার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশি লেখা-পড়া করছে তারা বেশি করে। হাইজ্যাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখা-পড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই। আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান; ঔষধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই তারাই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না। নিশ্চয় আমার কৃষক ভাইরা পারে না। নিশ্চয় আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশি আছে তারাই ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার। আর বিদেশি এজেন্ট কারা হয়? নিশ্চয়ই আমার কৃষক নয়, নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক নয়। আমরা যারা লেখা পড়া শিখি, গাড়িতে চড়ি, বিদেশে যাবার পারি, বিদেশিদের সঙ্গে মিশতে পারি, ভালো স্যুট পরতে পারি তারাই বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বিদেশের এজেন্ট হই ৷

মহাবিপদের মধ্যে আছি আমরা। আপনারা যারা বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত, যাঁরা দেশকে নেতৃত্ব দেন তাদের কর্তব্য হবে আত্মসমালোচনা করা। আর আওয়ামী লীগের সহকর্মী ভায়েরা, তোমরা ব্ল্যাক-মার্কেটিয়ারদের পিছনে লাগো। হোর্ডারদের পিছনে লাগো। ঘুষখোরদের পেছনে লাগো। তোমরা আমার কথায় আগেও লেগেছো, এখনো লাগো। শুধু আইন দিয়ে, শুধু শক্তি দিয়ে দুর্নীতি দমন করা যায় না। এজন্য এমনভাবে জনমত সৃষ্টি করতে হবে, যেমনভাবে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত জনমত সৃষ্টি করে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। যেমনভাবে ২৫ মার্চ থেকে ন’মাস পর্যন্ত জনমত সৃষ্টি করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলাম। তেমনি বাংলার মাটিতে জনমত সৃষ্টি করতে হবে- দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও শোষকদের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি, তাহলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি উঠে যাবে।

গণঐক্য জোট করেছেন আপনারা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ আছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাথে কর্মী আছে পাঁচটি গ্রুপের– আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ । আমি মাঝে মাঝে খবর পাই ভুল বোঝাবুঝি হয়। কোনো ভুল বোঝাবুঝি হতে পারবে না। সবার সাথে আলোচনা করে নিয়ে আপনাদের পাঁচ গ্রুপকে এক সাথে কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করছেন দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। সেইজন্য সংঘবদ্ধভাবে বসে আলোচনা করে আপনাদের কাজ করতে হবে। কারণ, আদর্শ আপনাদের এক নেতৃত্ব আপনাদের এক কর্মী আপনারা এক। সম্মুখে রাস্তা আপনাদের এক। গভর্নমেন্ট আপনাদের এক।

উৎপাদন বাড়াতে হবে

ভায়েরা আমার, পরিশ্রম না করলে, কঠোর পরিশ্রম না করলে সাড়ে সাত কোটি লোকের ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার এই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করা যাবে না। ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়দা করতে হবে। শ্রমিক ভাইদের কাছে আমার অনুরোধ, তোমাদের বার বার বলেছি, এখনো বলছি, প্রোডাকশন বাড়াও। সমাজতন্ত্রের অর্থ এই যে, প্রোডাকশন বাড়াও, ভোগ কর।

একবার এক মিটিংয়ে বলেছিলাম, গাইটা খেয়ো না, দুধ খাও। তোমরা কিছু লোক যা আরম্ভ করেছো, দুধও খাবার চাও, গাইও খাবার চাও। সেজন্যই বলছি প্রোডাকশন কর। আমি শ্রমিক ভাইদের সবাইকে দোষ দেই না। অনেক শ্রমিক প্রতিষ্ঠান আছে যারা ভালো প্রোডাকশন করছে, ভালো কাজ করছে। কৃষক ভাইরাও এগিয়ে এসেছে। তাদের অর্গানাইজ করতে হবে। এমনকি এ কথা ছাত্র ভাইদেরও বলি। দেখুন বগুড়ায় গিয়ে, কলেজের ছাত্ররা নিজেরা মাঠ চাষ করে। নিজের খরচ নিজেরাই কামাই করে লেখাপড়া আরম্ভ করে দিয়েছে। আপনারাও শুরু করেন। বাপ-মা’র উপর ট্যাক্স কম করেন। আজকে জিনিসের দাম দিন দিন বাড়ছে। বিদেশ থেকে আনতে হয়। দেশে ইনফ্লেশন হচ্ছে। মানুষের দুঃখ হবে। সেজন্য আজ আপনাদের এদিকে নজর দিতে হবে। আমি আপনাদের কাছে আজ আর বেশিক্ষণ বক্তৃতা করছি না। ইতিহাস বলে দেওয়ার দরকার ছিল বলেই এত কথা বলেছি।

আমি তোমাদের পরিষ্কার বলতে চাই, আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকতে পারবো না। তোমাদের নতুন সভাপতি করতে হবে। কারণ সময় আমি দেবার পারি না। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের কার্যপ্রণালীর মধ্যে যেটা আমি নিজে পাস করিয়েছিলাম তাতে পরিষ্কার বলা ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা গভর্নর হলে কেউই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি বা কর্মকর্তা হতে পারবে না। এটাকে আমি পরিবর্তন করতে চাই না। আমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করি যে, তোমরা আমার কথা রাখবা এবং আমার কথা শোনবা৷ আমি সব ঠিক করে দেব, তোমরা চিন্তা কর না গোছায়ে গোছায়ে ঠিক করে দেবো। সারা জীবন আমার কথা শুনেছো, এবারও শুনতে হবে।

মানুষের পাশে দাঁড়াও

আমি আগেই বলেছি যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যা প্রয়োজন আওয়ামী লীগের সেই চারটি জিনিস– নেতৃত্ব, আদর্শ, সংগঠন ও নিঃস্বার্থ কর্মী রয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ করেছি। আজ যে নতুন সংগ্রাম শুরু হয়েছে- দেশ গড়ার সংগ্রাম, দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার সংগ্রাম— এই সংগ্রামেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করি, যদি আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে তাহলে নিশ্চয়ই আমরা কামিয়াব হবো। কেউ আমাদেরকে ঠেকাতে পারবে না। বিশৃঙ্খলাকারীরা কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাই আজকে তোমাদের কাছে আমার আবেদন রইল— গ্রামে গ্রামে কাজ করো। দুঃখের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াও। তোমরা আমার কথা শুনেছো, এখনো আমার কথা শোনো। তোমাদের যা বলি সেভাবে কাজ করো। আমি যেখানেই থাকি তোমাদের সাথেই থাকবো, তোমাদের পাশেই থাকবো। তোমাদের বাদ দিয়ে একদিনও আমি বাঁচতে পারি না। কিন্তু সভাপতি আমি থাকতে পারবো না।আমি আমার পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে যারা বিদেশ থেকে এখানে এসেছেন। সেই যুগোশ্লাভিয়া, পোল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি, ভারত, রুমানিয়া, ইরাক, মালয়েশিয়া, হাঙ্গেরী ও দক্ষিণ রাষ্ট্রদূত ইয়েমেনের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। যারা আসতে পারেননি বলে আমাদের জানিয়েছেন এবং যারা এখানে কূটনৈতিক প্রতিনিধি ও রয়েছেন তাঁদের সকলকেও আমি আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমি আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করেছি এইজন্য যে, আজ প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগের কিছু ইতিহাস বলার, প্রয়োজন ছিল আপনাদের কিছু পথ দেখানোর। শুধু একটা কথা বলে যাই– শেষ কথা আমার, যে কথা আমি বার বার বলেছি— সোনার বাংলা গড়তে হবে। এটা বাংলার জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের প্রতিজ্ঞা। আমার আওয়ামী লীগের কর্মীরা, যখন বাংলার মানুষকে বলি, তোমরা সোনার মানুষ হও তখন তোমাদেরই প্রথম সোনার মানুষ হতে হবে। তাহলেই বাংলা গড়তে পারবা। আর যারা দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করেছো, তারা বাংলার দুঃখী মানুষের কাছ থেকে সরে যেয়ো না।

জয় বাংলা।

জয় আওয়ামী লীগ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ