অবিনশ্বর ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক তাৎপর্য

রিপোর্টার
সোমবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২২

নাসির আহমেদ

আজ অনন্য ঐশ্বর্যে ভাস্বর, গৌরবের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান ১০ জানুয়ারি। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের এইদিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন তার প্রিয় জন্মভূমি, স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলায়।

ত্রিশ লাখ শহীদদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করলেও সেই স্বাধীনতা যার অভাবে ছিল অপূর্ণ, সেই বীরসন্তান স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের সেই মহানায়কের স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসার স্মৃতিবিজড়িত ১০ জানুয়ারি নানা কারণেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

যিনি তার আজীবন সংগ্রাম আর অতুলনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে শুধু বাংলার মানুষের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই মহামানবের অবর্তমানে কেমন করে পূর্ণ হবে স্বাধীনতা? সে কারণেই পাকিস্তানি পরাজিত হানাদার বাহিনীর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটলেও, প্রতীক্ষার অবসান ঘটেনি বাংলাদেশ আর কোটি কোটি মানুষের। কেননা তার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে।

গভীর উৎকণ্ঠায় বাংলাদেশ প্রতীক্ষা করছিল তার প্রিয় নেতার ফিরে আসার। অবশেষে পাকিস্তানি শাসকচক্র বিশ্বজনমতের চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ওই দিন তিনি মুক্ত হয়ে পাকিস্তান থেকে সরাসরি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। তাকে বরণ করে নিয়েছিলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ।

তার সম্মানে আগেই সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল সেই বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত, যা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…। রাজ-অতিথির সম্মানে বেজে উঠল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কী অনন্য গৌরবের ঘটনা!

লন্ডনে একদিনের যাত্রা বিরতির পর ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে ভারতের নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সেদিন বাংলাদেশের কী অধীর প্রতীক্ষা তার জন্য! তিনি তার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসছেন- এই আনন্দসংবাদ ইথার তরঙ্গে মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল পৃথিবীর দিকে দিকে। ভারতের আকাশবাণী থেকে বেজে উঠল প্রখ্যাত শিল্পী সন্ধ্যা মুখার্জির কণ্ঠে একটি নতুন গান: ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে… কী ভালোবেসেছি আমরা তোমাকে বঙ্গবন্ধু…’

প্রখ্যাত কবি ও দেশবরেণ্য সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান ৯ জানুয়ারি রাতে লিখে ফেললেন ‘একান্ত মানচিত্র বাংলার’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর আগমনকে কেন্দ্র করে সেই সাড়া জাগানো কবিতা, যা ছাপা হয়েছিল ১০ জানুয়ারি সকালের দৈনিক বাংলার শেষ পৃষ্ঠায়।

এভাবে শুরুটা সেই কবিতার:

“একজন মানুষও কখনো হয়ে যায় অতুলন মহার্ঘ প্রতীক/ তখন আমরা সবাই তাঁকে পতাকার মতো ওড়াই …/

এখন পতাকার মতো সে আলাদা,/ যত খুশি তাকে ওড়াও, ওড়াও, ওড়াও…।

সেদিনের তরুণ ছড়াকার অজয় দাশগুপ্ত স্বাধীনতার অল্পকাল পরেই লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে একটি কবিতা যা আজও আমাদের চেতনায় প্রতিধ্বনি তোলে :

“তুমি না এলে বাঙালির কোনো বাসভূমি থাকতো না/

জননীকে কেউ ‘আমার সোনার বাংলা’ ডাকতো না/

শহীদমিনারে লাল গোলাপের শ্রদ্ধা কেউ রাখতো না/

চাঁদ-তারার নিশানা মুছে সূর্যকে আঁকতো না/

তুমি না এলে জাতীয় জীবন কেটে যেত ভুলে, ভুলে/

বাঙালি পেতো না নিষিদ্ধ রবি, বিদ্রোহী নজরুলে/

তুমি না এলে কে জাগাতো বলো শহর নগর গ্রাম/

কে শোনাতো সেই অমর কাব্য ‘এবারের সংগ্রাম’/”

বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিবিজড়িত এই দিনে মনে পড়বে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর লোকারণ্য। অশ্রুসিক্ত বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমেই স্পর্শ করলেন প্রিয় মাতৃভূমির মাটি, ডান হাতে কপালে ছোঁয়ালেন। সবার মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত গান-

“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা…!”

তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে তিনি সোজা চলে গেলেন সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে, যেখান থেকে ৭ মার্চ তিনি তার প্রিয় দেশবাসীকে ডাক দিয়েছিলেন এই বলে- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

তেমনি বিহ্বল কণ্ঠেই তিনি তার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছে বর্ণনা করলেন পাকিস্তানের কারাগারে কীভাবে কনডেমসেলে কেটেছিল তার নয় মাসের মৃত্যুমাখা দিনরাত্রি। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে যেন তার লাশটি বাংলাদেশের মাটিতে ফেরত পাঠানো হয় এই আকুতি সেদিনই আমরা জানতে পেরেছিলাম বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে।

মায়ের কোলে ফিরে আসা হারানো সন্তান যেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে অশ্রুতে রোরুদ্যমান হয়ে ওঠে, তেমনি অশ্রুসিক্ত ছিলেন তিনি সেদিন। সেই ভরাট কণ্ঠস্বরও সেদিন কেমন রুদ্ধ হয়ে আসছিল!

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম। তিনি যদি ফিরে না আসতেন, তাহলে বাংলাদেশ থেকে আজও ভারতীয় সৈন্য যে ফিরে যেত না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালে কিংবা পরবর্তীকালে যুদ্ধাবস্থায় সহযোগী শক্তিগুলোর সৈনিকদের অবস্থানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও এর সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই।

কখনোই কোনো দেশের সহযোগী শক্তি মিত্রবাহিনী সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়নি। নিকট অতীতে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা ৩০ বছর পরে ইরাক ছেড়েছে সম্প্রতি। সৌদি আরব থেকে আজও মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার হয়নি আর ভবিষ্যতে কখনো হবে কি না তাও বলা মুশকিল। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ৭৬ বছর পরেও কোনো কোনো দেশ থেকে মিত্রবাহিনী আর ফিরে যায়নি স্বদেশে।

বঙ্গবন্ধু যদি ফিরে আসতে না পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভসহ বহু দেশের স্বীকৃতিসহ মাত্র সাড়ে তিন বছরে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সদস্যপদ লাভ এবং নানা স্বীকৃতি অর্জন করে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই ভিত্তিও গড়ে তোলা সম্ভব হতো কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।

যে কুশলী পররাষ্ট্রনীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তার কোনো তুলনা নেই। সমাজতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদী দর্শনে বিভক্ত পরাশক্তির আগ্রাসনে প্রকম্পিত পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো একটি নবীন রাষ্ট্রের অবস্থান চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, শুধু বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্ব আর সাহসী সিদ্ধান্ত এবং ব্যক্তিগত প্রভাব পরাশক্তির প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও সদ্যজাত দরিদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে পারেনি।

চরম অভাব অনটনের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে, কপর্দকহীন বাংলাদেশকে তিনি যেভাবে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় গড়ে তুলতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছিলেন, মূলত বঙ্গবন্ধুর সেই ভিত্তির ওপরেই আজকের বাংলাদেশ, দারিদ্র্যের অভিশাপ কাটিয়ে মধ্যম আয়ের মর্যাদাবান একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশাল এবং বিস্তৃত। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি হাজার বছরের পরাধীন একটি জাতিকে শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যাননি, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা হিসেবেও তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ